চাকরির পরীক্ষায় ভাবসম্প্রসারণ লেখার উপায়

বিসিএসসহ চাকরির বিভিন্ন লিখিত পরীক্ষায় ভাবসম্প্রসারণ লিখতে হয়। কিন্তু ঠিক কীভাবে লিখলে এ অংশে ভালো নম্বর পাওয়া যায়, তা অনেকেরই জানা নেই। এ নিয়ে জানাচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক তারিক মনজুর

বিসিএসসহ চাকরির বিভিন্ন লিখিত পরীক্ষায় ভাবসম্প্রসারণ লিখতে হয়
 ছবি: চাকরি–বাকরি

বিসিএস পরীক্ষায় ভাবসম্প্রসারণের জন্য নির্ধারিত নম্বর ১৫। এটি লেখার জন্য পাবেন ১৫ মিনিট সময়। ১০ম বিসিএস থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত যেসব প্রশ্ন এসেছে, সেগুলোকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়:

● শিক্ষা বা জ্ঞান–সম্পর্কিত: জ্ঞানহীন মানুষ পশুর সমান; বিদ্যা যতই বাড়ে ততই জানা গেল যে কিছুই জানা হলো না; অজ্ঞতার সঙ্গে মনের দাসত্বের যোগ অতি ঘনিষ্ঠ; জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট—মুক্তি সেখানে অসম্ভব।

● কালচার ও সংস্কৃতি–সম্পর্কিত: কালচার সমাজতান্ত্রিক নয়, ব্যক্তিতান্ত্রিক; সংস্কৃতি শব্দটি উচ্চারণ করা সহজ, বোঝা কঠিন এবং বোঝানো কঠিনতর; সাহিত্য, শিল্প, সংগীত কালচারের উদ্দেশ্য নয়–উপায়; কমল–হীরের পাথরটাকে বলে বিদ্যে, আর তা থেকে যে আলো ঠিকরে বেরোয়, তার নাম কালচার।

● মানুষের কর্ম–সম্পর্কিত: জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভালো; কষ্ট না করলে কেষ্ট পাওয়া যায় না; মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে, বয়সের মধ্যে নয়; পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না; মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়; স্মরণের আবরণে মরণেরে যত্নে রাখে ঢাকি; বার্ধক্য তাহাই—যাহা পুরাতনকে, মিথ্যাকে, মৃত্যুকে আঁকড়াইয়া পড়িয়া থাকে।

● প্রবাদ-প্রবচনভিত্তিক: নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা; অল্প জলের তিতপুঁটি, তার এত ছটফটি; চাঁদেরও কলঙ্ক আছে; গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো; লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু; যত মত তত পথ; যে সহে, সে রহে; শৃঙ্খলিত সিংহের চেয়ে স্বাধীন গাধা উত্তম; অভাগার গরু মরে, ভাগ্যবানের বউ মরে।

● কবিতাংশ থেকে: ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/ পূর্ণিমা–চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি; মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয়/ আড়ালে তার সূর্য হাসে; অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/ তব ঘৃণা তারে যেন তৃণ সম দহে; যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে/ সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে; শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির/ লিখে রেখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির; উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে/ তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে।

● গদ্যাংশ থেকে সুভাষিত উক্তি: বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না; ফ্যাশানটা হল মুখোশ, স্টাইলটা হল মুখশ্রী; স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন; জাতীয় জীবনে সন্তোষ এবং আকাঙ্ক্ষা দুয়েরই মাত্রা বাড়িয়া গেলে বিনাশের কারণ ঘটে; যে-আমির মধ্যে তুমি নেই, আর যে-তুমির মধ্যে আমি নেই দুইই আমার পক্ষে সমান।

এবার লেখার উপায় নিয়ে আলোচনা করা যাক। ভাবসম্প্রসারণ লেখার জন্য একটি কাঠামো অনুসরণ করতে হয়। তা ছাড়া বিষয় উপস্থাপনেরও বিশেষ কৌশল রয়েছে।

আয়তন ও কাঠামো: তিনটি অনুচ্ছেদে ভাবসম্প্রসারণ লিখবেন। মোট বাক্যের সংখ্যা হতে পারে ২০। এ ক্ষেত্রে প্রথম অনুচ্ছেদে ৩-৪টি বাক্য; দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ১৪-১৫টি বাক্য এবং তৃতীয় অনুচ্ছেদে ১-২টি বাক্য। প্রথম অনুচ্ছেদে মূল বিষয় তুলে ধরবেন। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করবেন। তৃতীয় অনুচ্ছেদে মন্তব্য লিখবেন।

বিষয় উপলব্ধি: প্রশ্নের উদ্ধৃতিতে সিংহ-গাধা, পুঁটিমাছ, পুষ্প ইত্যাদি বিভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণা থাকে। তবে সেগুলো দিয়ে মূলত মানুষকে বা মানুষের প্রবণতাকে বোঝানো হয়। তাই আলোচনা মানুষকে কেন্দ্র করে হবে। প্রয়োজনীয় যুক্তি ও দৃষ্টান্ত দিয়ে বক্তব্যের বিষয়কে উপস্থাপন করবেন। প্রাসঙ্গিক হলে ঐতিহাসিক, পৌরাণিক বা বৈজ্ঞানিক তথ্য উল্লেখ করা যায়। একই কথার পুনরাবৃত্তি না করাই ভালো।

১ম অনুচ্ছেদ: এখানে শব্দের ব্যাখ্যা দেওয়ার দরকার হয়। যেমন ‘পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি’লেখার জন্য পরিশ্রম, সৌভাগ্য ও প্রসূতি শব্দ তিনটির ব্যাখ্যা দিতে হয়। আবার, ‘কালচার ব্যক্তিতান্ত্রিক নয়, সমাজতান্ত্রিক’লেখার জন্য কালচার ও সংস্কৃতির সুক্ষ্মতর পার্থক্য তুলে ধরতে হয়।

২য় অনুচ্ছেদ: এই অনুচ্ছেদে মূল আলোচনা থাকবে। বিষয়কে ব্যাখ্যা করার জন্য এখানে একই জাতীয় অন্য ভাবসম্প্রসারণের সহযোগিতা নেবেন। যেমন ‘জ্ঞানহীন মানুষ পশুর সমান’ লেখার জন্য বিদ্যা বা জ্ঞান–সম্পর্কিত অন্যান্য ভাবসম্প্রসারণের ভাববস্তু গ্রহণ করবেন। লেখায় এ রকম কথা যোগ করতে পারেন: অজ্ঞতার সঙ্গে মানুষের মনের দাসত্বের যোগ রয়েছে। আবার কেবল পুথিগত বিদ্যা দিয়ে জীবনে সফল হওয়া যায় না।

প্রয়োজনে মনীষীদের নাম উল্লেখ করতে হয়। যেমন ‘জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো’লেখার জন্য পৃথিবীতে সফল কয়েকজন মনীষীর নাম উল্লেখ করবেন। নামগুলো বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে নেবেন। লিখতে পারেন এভাবে—রাজনীতিবিদ নেলসন ম্যান্ডেলা, বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন, সাহিত্যিক কাজী নজরুল ইসলাম, সমাজসেবী মাদার তেরেসা তাঁদের কর্ম দিয়ে মানুষের মনে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।

অনুরূপ কোনো কথা বা প্রবাদ থাকলে এর উল্লেখ করবেন। যেমন ‘নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা’লেখার সময় বলবেন, অনুরূপ একটি প্রবাদ ইংরেজিতেও আছে: A bad workman quarrels with his tools। অনুরূপ প্রবাদ না পেলে বিপরীত প্রবাদের কথাও লিখতে পারেন।

২য় অনুচ্ছেদের শেষ দিকে এসে দুই থেকে তিন বাক্যে সম্পূর্ণ বিপরীত যুক্তিতে বিষয়টি দেখার চেষ্টা করবেন। যেমন, ‘পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না’ লেখার জন্য বলবেন, ‘অন্যভাবে দেখা যায়, পুষ্প আসলে নিজের জন্যই ফোটে। পুষ্পের রং, পুষ্পের সৌরভ এগুলো তার পরাগায়নের জন্য হয়ে থাকে।’ তবে এগুলো যেহেতু মূল বক্তব্যের বিপরীত কথা, তাই দ্রুত বিষয়টিকে মূল বক্তব্যের সঙ্গে সম্পর্কিত করবেন ‘একইভাবে মহৎ ব্যক্তিরাও তাঁদের কর্মের মাধ্যমে প্রকারান্তরে নিজেদের মঙ্গল ঘটান। তাঁরা তাঁদের কর্মের মাধ্যমে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন এবং মানুষের মনে বহুদিন বেঁচে থাকেন।

৩য় অনুচ্ছেদ: শেষ অনুচ্ছেদে এমন কথা লিখবেন, যা আগে লেখেননি। এখানে আপনার চাওয়া বা আশাবাদ ব্যাখ্যা করবেন। যেমন ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’ ভাবসম্প্রসারণে লিখতে পারেন, আমরা চাই ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি সুষম পৃথিবী।

সতর্কতা

● প্রশ্নে দেওয়া উক্তিটি কোনো বিশিষ্ট কবি বা লেখকের হতে পারে। আপনি বুঝতে পারলেও সেই কবি বা লেখকের নাম উল্লেখ করবেন না। এমনকি এভাবেও লিখবেন না ‘কবি এখানে বলতে চয়েছেন’, ‘লেখকের মতে’ ইত্যাদি।

● প্রশ্নে নির্দিষ্টসংখ্যক বাক্যে লিখতে বলতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাক্য কমাতে ‘দাঁড়ি’র (।) বদলে সেমিকোলন (;) ব্যবহার করুন। আর বাক্যের সংখ্যা বাড়াতে হলে ছোট ছোট বাক্যে লিখুন।