ইতিমধ্যে বাজেট নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। অর্থনীতির সূচক কোনোটি ভালো, কোনোটিতে চাপ—এমন প্রেক্ষাপটে আসছে নতুন বাজেট।
নতুন অর্থবছরের বাজেটের আকার সাড়ে ৭ লাখ কোটি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এ রকম এক বিশাল বাজেট তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য সরকারের লক্ষ্য সাড়ে ৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নতুন বাজেটের লক্ষ্য থাকবে মূলত পাঁচটি। যেমন রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, বাজেট ঘাটতি সীমার মধ্যে রাখা, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ।
৫ এপ্রিল ফিসক্যাল কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের সভা করবে অর্থ মন্ত্রণালয়। ওই বৈঠকেই সামষ্টিক অর্থনীতির নীতি, বাজেটের মূল দর্শন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি—এসব ঠিক করা হবে। পরে সম্পদ কমিটির সভায় সেই আলোকে বরাদ্দ চূড়ান্ত করা হবে। আগামী জুন মাসের প্রথমার্ধে নতুন বাজেট দেওয়া হবে।
এর আগে অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রাক্-বাজেট আলোচনা করেছেন অর্থমন্ত্রী। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও (এনবিআর) আলাদা করে বিভিন্ন ব্যবসায়ী চেম্বার ও সমিতি এবং সংগঠনের সঙ্গে বাজেট নিয়ে আলোচনা করছে। বাজেট সাধারণত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের সূচক ধরেই প্রস্তুত করা হয়। ফলে ৯ মাস শেষ হতেই অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেট তৈরির মূল প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অর্থবছরের শুরুতে দেশের অর্থনীতির নানা সূচকের ওপর বড় চাপ পড়লেও কয়েকটি ক্ষেত্রে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। আমদানি ব্যয়ও সরকার উদ্যোগ নিয়ে কমিয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতির চাপ এখনো আছে। দুশ্চিন্তা রয়েছে রাজস্ব আদায়, ডলারের দর এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়েও।
নতুন বাজেট নিয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সামষ্টিক অর্থনীতির চাপের কেন্দ্রে আছে রিজার্ভ ও মূল্যস্ফীতি। প্রবাসী আয়, রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা এবং ঋণপত্র খোলা নিয়ন্ত্রণে এনে রিজার্ভ পড়ে যাওয়ার গতি শ্লথ করা গেছে। তাই রিজার্ভ নিয়ে উদ্বেগ কিছুটা কমেছে। কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় মূল্যস্ফীতি চাপ ফেলছে। আগামী বাজেটে মানুষের ওপর এই চাপ কমানোই সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, রাজস্ব খাতের সমস্যা পুরোনো। শুল্ক-কর বাড়ানোর জন্য আইএমএফের শর্ত আছে। আগামী বাজেটে শুল্ক-কর বাড়াতে কোন পথে হাঁটে সরকার, সেটাই দেখার বিষয়।
অর্থনীতির সুখবর হলো, প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় এখনো ভালো অবস্থানে আছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসের (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এ সময়ে ১ হাজার ৪০১ কোটি ডলারের বেশি প্রবাসী আয় এসেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫৮ কোটি ডলার বেশি। গত ২০২১ ও ২০২২ সালে সব মিলিয়ে নতুন ১৭ লাখ বাংলাদেশি প্রবাসে গেছেন। কোভিডের পর তাঁরাই প্রবাসে থাকা শ্রমিকদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। প্রবাসী আয়ের ইতিবাচক ধারা ধরে রেখেছেন তাঁরা।
রপ্তানি আয়েও ভালো অবস্থা। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৯ শতাংশের মতো। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপ-আমেরিকার অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিলে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রভাব পড়তে পারে।
বাজেটের খরচের ৮০ শতাংশের বেশি জোগান দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কিন্তু রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে আছে এনবিআর। প্রথম আট মাসে শুল্ক-কর আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ২২ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের লক্ষ্য কমিয়ে সাড়ে ৩ লাখ করতে চায় এনবিআর। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় এখনো তাতে সায় দেয়নি। কেননা সরকারি কর্মকর্তাদের বেতনভাতা, ঋণের কিস্তি-সুদ খরচ—এসব অবধারিত। এ ছাড়া বড় খরচ হয় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি)। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এডিপির ৩২ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের খরচসহ এডিপির আকার ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খরচ হয়েছে ৮২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। অবশ্য এখন এডিপির আকার কমিয়ে ২ লাখ ২৭ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা করা হয়েছে। প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় গাড়ি কেনা বন্ধ, জ্বালানি তেল সাশ্রয়সহ নানা অগ্রাধিকার প্রকল্পের তালিকা করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মূলত গত বছরের এপ্রিল থেকেই ডলারের দাম বাড়তে থাকে। তখন প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা, যা এখন গড়ে ১০৫ টাকার বেশি। একই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারের পণ্যের দাম ছিল বেশি। ফলে বেশি দামে ডলার কিনে আমদানি করতে গিয়ে রিজার্ভ কমে যায়। যে রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের, তা এখন ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলারে নেমেছে।
ডলার-সংকট মোকাবিলা করে রিজার্ভ ধরে রাখতে গত বাজেটের আগে এবং বাজেটে গাড়ি, ফলমূল, প্রসাধনসামগ্রীসহ বিভিন্ন ধরনের বিলাসপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্ক-কর বৃদ্ধি এবং এলসি মার্জিন বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
আগামী বাজেটে অর্থমন্ত্রীর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে মূল্যস্ফীতি বাগে আনা। চলতি অর্থবছরের আগস্ট মাসে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। ফলে মূল্যস্ফীতি এক লাফে সাড়ে ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, ফেব্রুয়ারি মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এই লক্ষ্য ধরে রাখা কঠিন হবে।
কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। আবার বাড়তি মূল্যস্ফীতি, ডলার-সংকটসহ নানা চাপের মধ্যেও অর্থমন্ত্রীকে বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। আবার আইএমএফের শর্ত মেনে রাজস্ব ও আর্থিক খাতের সংস্কারও করতে হবে।
বাংলাদেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৩ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়। আবার যা বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা-ও খরচ করা যায় না। অর্থবছরের শেষ দিকে বরাদ্দ কমাতে হয়।
অন্যদিকে এবার মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি থাকায় গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষকে আরও বেশি সুরক্ষার আওতায় আনতে হবে। সে জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। ১২২টির বেশি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থাকলেও সব কটি গরিব মানুষের জন্য নয়। যেমন পেনশনের টাকাও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বরাদ্দ দেওয়া হয়। আবার শহরের গরিবদের জন্য কোনো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নেই।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আলাদা করে যেসব বাজেট আলোচনা করেছেন, সেখানে কর কমানোর দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। মূল্যস্ফীতির বাড়তি চাপে একটু স্বস্তি দিতে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা থেকে আরও বাড়ানোর সুপারিশও এসেছে।
এদিকে আইএমএফের ঋণের শর্ত হিসেবে আগামী অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব খাতে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। এ সময়ে জিডিপির অতিরিক্ত দশমিক ৫ শতাংশ রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ থাকতে হবে। বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বিভিন্ন খাতের করছাড়ও কমাতে হবে। এ জন্য এনবিআর একটি কমিটি করেছে। ওই কমিটি বাজেটের আগে কোথায় কোথায় করছাড় যৌক্তিকীকরণ করার বিষয়ে প্রতিবেদন দেবে।
সব মিলিয়ে নতুন বাজেটের আকার হবে সাড়ে ৭ লাখ কোটি টাকার বেশি। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা, যা সংশোধন করে হতে পারে ৬ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা। নতুন এডিপি হতে পারে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা, আর বাজেট ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হতে পারে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব ব্যয়ের মধ্যে সুদ ব্যয় থাকবে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এ সময় মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য রাখা হতে পারে ৬ শতাংশ।