সবারই স্বপ্ন থাকে নিজের একটি স্থায়ী আবাসের। নিজের একটা বাসস্থান মানুষের আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়। বর্তমানে ফ্ল্যাট কেনার দিকে আগ্রহী ক্রেতার সংখ্যা বাড়ছে। জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা সাহাদাত হোসেন ফ্ল্যাট কেনার জন্য বেশ কিছুদিন ধরে খোঁজ–খবর নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘ফ্ল্যাট মানে একটি স্থায়ী আমানত। অজ্ঞতা বা সঠিক তথ্য না নেওয়ার কারণে সারা জীবনের সঞ্চয়কে জলাঞ্জলি দিয়ে যেন নিঃস্ব হতে না হয়, সে জন্য জেনে–বুঝে সবকিছু দেখেশুনেই ফ্ল্যাট কিনতে চাই।’
ফ্ল্যাট কেনার আগে নানা রকম ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয় ক্রেতাদের। এমনও হয়েছে, ফ্ল্যাট কেনার পর সেটা বুঝে পেতেই কয়েক বছর লেগে যায়! অ্যালায়েন্স বিল্ডার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান জানান, ফ্ল্যাট কেনার সময় বেশ কিছু জিনিস মাথায় রাখতে হবে।
এর মধ্যে লোকেশনটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ছোটবেলা থেকে যিনি মিরপুরে থেকেছেন, তিনি কখনোই আজিমপুরে ফ্ল্যাট কিনবেন না বা কেনা উচিত নয়। লোকেশনসহ সবকিছু মিলে গেলেই পছন্দের ফ্ল্যাটটি কেনার চিন্তা করা উচিত। এ ছাড়া পছন্দ হওয়া ফ্ল্যাটটির যাবতীয় দলিল-দস্তাবেজ এবং জমিজমার কাগজপত্র সঠিক আছে কি না—সেটা ভালোভাবে দেখা উচিত।’
স্বপ্নের ফ্ল্যাট কেনার আগে তাই প্রথমেই দেখতে হবে স্থান। অর্থ্যাৎ ফ্ল্যাটটির অবস্থান কোথায়। সেখান থেকে হাটবাজার, নিজের কর্মক্ষেত্র, স্কুল, কলেজ, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, হাসপাতাল ইত্যাদির দূরত্ব এবং যোগাযোগব্যবস্থার সুবিধাগুলো কেমন। আপনার কর্মক্ষেত্র বা বাচ্চাদের স্কুল–কলেজ অনেক দূরে হলে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য পাবেন না। যোগাযোগব্যবস্থা অনেক বড় একটা বিবেচ্য বিষয়। নিকট আত্মীয়স্বজন কাছাকাছি আছে কি না, সেটাও দেখা উচিত।
যে প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তির ফ্ল্যাট কিনতে যাচ্ছেন, তার মালিকানা আছে কি না প্রথমেই সে বিষয়টি নিশ্চিত হতে হবে। ক্যাপিটাল ল চেম্বার সহযোগী আইনজীবী সাঈদ হাসান মেনন বলেন, ঢাকা শহরের এক জমি অনেকের কাছে বিক্রি করার নজির আছে। তাই ফ্ল্যাট কেনার সময় আইনের বিষয় গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত। সম্ভব হলে ফ্ল্যাটের জমিসহ নানা বিষয় নিয়ে কোনো ল মেম্বারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। প্রস্তাবিত ফ্ল্যাটটি যে জমিতে অবস্থিত, তার সর্বশেষ রেকর্ডে বিক্রয়কারীর নাম উল্লেখ আছে কি না, সিএস, আরএসসহ অন্যান্য খতিয়ানের ক্রম মিলিয়ে দেখতে হবে। আর রিয়েল এস্টেট কোম্পানিটির যথাযথ নিবন্ধন আছে কি না, রিহ্যাবের সদস্য কি না—এসব বিষয়েও খোঁজ নেওয়া উচিত। জমিটি যদি ডেভেলপার কোম্পানি কোনো মালিকের কাছ থেকে নিয়ে থাকে, তাহলে এ সম্পর্কে চুক্তিপত্র যাচাই করতে হবে। জমিটির নামজারি ঠিক আছে কি না, সেটা পরীক্ষা করা উচিত। বিক্রয়কারী ওয়ারিশসূত্রে জমির মালিক হয়ে থাকলে বণ্টনের মোকদ্দমা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।
এ ছাড়া প্রস্তাবিত ফ্ল্যাটটি সরকারের খাসজমিতে পড়েছে কি না কিংবা সরকারের কোনো স্বার্থ থাকার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। জমিটি অর্পিত সম্পত্তি কিংবা পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকায় আছে কি না, দেখতে হবে সেটাও। জমিটি আগে কোনো সময়ে অধিগ্রহণ হয়েছে কি না বা প্রক্রিয়াধীন কি না, ওয়াক্ফ, দেবোত্তর অথবা কোর্ট অব ওয়ার্ডসের জমি কি না—এসব বিষয় সম্পর্কে খোঁজ–খবর নিতে হবে। জমিটি কখনো খাজনা অনাদায়ের কারণে নিলাম হয়েছে কি না, তা–ও খোঁজ নিতে হবে বলে জানান সাঈদ হাসান মেনন।
ফ্ল্যাট বা ভবনটি কার ডিজাইনে করা, স্থপতি ও ইঞ্জিনিয়ার কে খোঁজ নিন। তাঁদের অন্য কাজের মান কেমন দেখে নিতে পারেন। ভবনের সব ধরনের ওয়ার্কিং ড্রইংয়ের এক সেট ফটোকপি নিন। এটা আপনার পরিচিত বা বিশ্বস্ত কোনো স্থপতি বা প্রকৌশলীকে দেখিয়ে নিন। বাইরে থেকে দেখতে সুন্দর হলেও কোনো কোনো ভবনে অত্যন্ত নিম্নমানের কাজ করে অল্প খরচে বানানো হয়, যেগুলোর গুণগত মান ঠিক থাকে না।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউক কর্তৃক ভবন নির্মাণের অনুমতি আছে কি না, সেটা দেখতে হবে। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, নকশা ছাড়াই ভবন তৈরি করে। সে ক্ষেত্রে আইন না মানার কারণে পরবর্তীকালে রাজউক বাড়তি বা অতিরিক্ত স্থান ভেঙে দেয়। গ্যাস, পানি এবং বিদ্যুৎ–সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
জমির মাটির পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত, এতে জানা যাবে মাটি কতটা শক্তপোক্ত এবং কতটা ধারণক্ষমতাসম্পন্ন। বর্তমানে রাজধানীর পুকুর–জলাশয়গুলো ময়লা দিয়ে পূর্ণ করে তাতে ফ্ল্যাট তৈরি করে বিক্রি করা হচ্ছে। ফ্ল্যাট কেনার আগে এসব বিষয় সম্পর্কে সচেতন ও সাবধান থাকতে হবে।