বিশ্ববাজার ও দেশীয় বাজারের চেয়ে অস্বাভাবিক কম দামে চিনি কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। সরকারি বিক্রয়কারী সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ১২ হাজার ৫০০ টন চিনি সরবরাহের এ কাজ পেয়েছে। তারা এই চিনি কিনবে সিঙ্গাপুরের প্রিন্সিপাল মেট্রিস প্রাইভেট লিমিটেড থেকে।
গতকাল বুধবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ চিনি কেনার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন ১৩ সদস্যের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, এলজিআরডিমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রীরাও আছেন। বুধবার অনুষ্ঠিত বৈঠকে তাঁদের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সাঈদ মাহবুব খান সাংবাদিকদের চিনি কেনার প্রস্তাব অনুমোদনের তথ্য জানান। সাঈদ মাহবুব খান জানান, প্রতি টন চিনির মূল্য ধরা হয়েছে ৪৭৭ দশমিক ৯৪ মার্কিন ডলার। এতে মোট ব্যয় হবে ৫৯ লাখ ৭৪ হাজার ২৫০ মার্কিন ডলার। প্রতি ডলার ১০৮ টাকা হিসাবে বাংলাদেশি মুদ্রায় দাম পড়বে ৬৪ কোটি ৫২ লাখ ১৯ হাজার টাকা।
১ টনে ১ হাজার কেজি, সেই হিসাবে ১২ হাজার ৫০০ টনে হয় ১ কোটি ২৫ লাখ কেজি। এ হিসাবে প্রতি কেজি চিনির দাম পড়ে ৫১ দশমিক ৬১ টাকা।
বর্তমান বাজারদরের চেয়ে এত কমে চিনি কেনার প্রস্তাব তাহলে কীভাবে অনুমোদন করল ক্রয় কমিটি, এমন প্রশ্নের জবাব জানতে মুঠোফোনে বুধবার রাতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে। তিনি বৈঠকে ছিলেন না বলে জানান।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, টিসিবির চেয়ারম্যানের কাছ থেকে তিনি শুনেছেন, অনেকে ক্রয় কমিটিতে অনুমোদনের পর টিসিবি থেকে যে কার্যপত্র পান, তা পরে অন্যদের কাছে বিক্রি করে দেন। এ কারণে তাঁদের জমা থাকা টাকা আর ফেরত পান না। যদি প্রতি টন চিনির অনুমোদিত দাম ৪৭৭ দশমিক ৯৪ ডলার হয়, তাহলে তা অস্বাভাবিক।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ১১ জুন অনুষ্ঠিত দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের বৈঠকে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) যে ২০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন উপস্থাপন করে তাতে বলা হয়, পরিশোধিত চিনির ক্ষেত্রে শুল্ক-কর ৬৭ শতাংশ। তাতে প্রতি কেজিতে দাম যোগ হবে ৩৪ দশমিক ৮৪ টাকা; অর্থাৎ ক্রয় কমিটিতে অনুমোদিত প্রতি কেজি চিনির দাম পড়বে ৮৬ দশমিক ৪৫ টাকা।
টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আরিফুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘উন্মুক্ত দর পদ্ধতিতে অংশ নিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজ পেয়েছে প্রিন্সিপাল মেট্রিস প্রাইভেট লিমিটেড। চিনি সরবরাহ করতে না পারলে কোম্পানিটির পারফরম্যান্স গ্যারান্টির (পিজি) টাকা বাতিল হয়ে যাবে।’ আরিফুল হাসান এ-ও বলেন, অনেকে কাজ পেয়েও পণ্য সরবরাহ করতে পারে না।
বুধবার খুচরা বাজারে চিনি কেনাবেচা হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে। বিটিটিসি যখন খোলা ও প্যাকেটজাত চিনির দাম ১০৪ থেকে ১০৯ টাকা ঠিক করেছিল দুই মাস আগে, বাজারে তা কার্যকর হয়নি। তখন থেকেই বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছিল ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে।
এক মাস আগে বিটিটিসি নতুন দর ঠিক করে প্রতি কেজি ১২০ থেকে ১২৫ টাকা। এ দরও মেনে নেননি ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতা পেয়ে টিসিবি কৌশল হিসেবে ওয়েবসাইটে বলে আসছে, বাজারে চিনি বেচাকেনা হচ্ছে ১২০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে।
অস্বাভাবিক কম দাম নিয়ে জানতে চাইলে বৈঠক শেষে সাঈদ মাহবুব খান প্রথম আলোকে বলেন, সবকিছু দেখেশুনেই প্রস্তাব অনুমোদন করেছে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি।
বিটিটিসি ১১ জুন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বেড়েছে ২১ দশমিক ৯৬ শতাংশ; অর্থাৎ ২০২২ সালের ৮ জুন আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম ছিল ৫৫১ দশমিক ৯৫ মার্কিন ডলার। আর ২০২৩ সালের ৮ জুন তা বেড়ে হয় ৬৭৩ দশমিক ১৫ ডলার।
দেশের অন্যতম চিনি পরিশোধন কারখানার নাম আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারি লিমিটেড। আবদুল মোনেম গ্রুপ অব কোম্পানিজের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম মহিউদ্দিন মোনেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে যেখানে প্রতি টন চিনির দাম ৭০০ থেকে ৮০০ ডলার, সেখানে ৪৭৭ দশমিক ৯৪ ডলার দরে কীভাবে চিনি কেনার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়, তা আমার জানা নেই।’
এর আগে গত ২৫ মে ব্র্যান্ড শেয়ার ট্রেডিং লিমিটেড নামের কাগুজে এক দেশীয় কোম্পানি থেকে ১০৫ টাকা কেজি দরে ১২ হাজার ৫০০ টন চিনি কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করেছিল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের নেতৃত্বাধীন ক্রয় কমিটি।
টিসিবি সূত্রে জানা গেছে, ২৫ মে অনুমোদিত চিনি পাওয়ার আশা টিসিবি করছে না।
বুধবার অনুমোদিত প্রস্তাবের চিনি পাওয়ার আশাও সংস্থাটি বাদ দিতে পারে।