বিনিয়োগের দ্বিতীয় ঢেউ লেগেছে ঢেউটিনে। গত তিন বছরে নতুন দুটি বড় কারখানা যুক্ত হয়েছে এ খাতে। বিনিয়োগের পরিকল্পনায় রয়েছে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
দুই দশক আগেও ঢেউটিন বলতে ছিল জিংকের প্রলেপযুক্ত সাধারণ টিন। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঢেউটিনেও রঙের ছোঁয়া লাগে। তাতে শুরু হয় রং ও পুরুত্বের বৈচিত্র্য। এখন এ খাতে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন পণ্য। কারখানার ছাদে এখন সাধারণ টিনের বদলে জায়গা করে নিয়েছে নানা ধরনের ঢেউয়ের টিন বা প্রোফাইল। প্রোফাইলের পাশাপাশি জিংক ও অ্যালুমিনিয়ামের প্রলেপযুক্ত ঢেউটিনসহ নতুন নতুন পণ্য যোগ হয়েছে এ তালিকায়।
ঢেউটিনে এ বৈচিত্র্য এসেছে ইস্পাতের পাতশিল্পের হাত ধরে। মূলত দেশের পাঁচ শিল্পগোষ্ঠী ঢেউটিনের বাজারে নতুন নতুন পণ্য যুক্ত করেছে। বৈচিত্র্য আনতে এ খাতে নতুন বিনিয়োগ করছে তারা। তাদের দেখানো পথে নতুন প্রতিষ্ঠানও বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে।
দেশীয় উদ্যোক্তাদের হাত ধরে এ শিল্পে আমদানিনির্ভরতা কমছে। তাতে সাশ্রয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। বাড়ছে কর্মসংস্থান। ইস্পাতের মতো মৌলিক শিল্পেও দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে। ভবিষ্যতে ঢেউটিনের চাহিদা কমলেও তা নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই উদ্যোক্তাদের। কারণ এ শিল্পে নতুন নতুন পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে।
বাংলাদেশে ঢেউটিন খাতের শুরুটা হয়েছিল চিটাগাং স্টিল মিলসের মাধ্যমে। দেশ স্বাধীনের আগে ১৯৬৭ সালে চালু হওয়া সরকারি এ কারখানায় বিলেট, লোহার পাতের পাশাপাশি ঢেউটিনও তৈরি হতো। ১৯৯৯ সালে এ কারখানা বন্ধ হয়ে যায়; যদিও এর কয়েক বছর আগেই উৎপাদন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কারখানাটির। বিশ্বব্যাংকের ১৯৭৬ সালের এক সমীক্ষায় বলা হয়, দেশ স্বাধীনের পরও এ কারখানায় বছরে সাত থেকে আট হাজার টন ঢেউটিন উৎপাদিত হতো।
সরকারি এ কারখানার উৎপাদন দিয়ে চাহিদা মেটানো যেত না; তাতে ঢেউটিন ছিল আমদানিনির্ভরতা। চট্টগ্রাম বন্দরের ১৯৭৪-৭৫ সালের বর্ষপঞ্জিতে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর প্রতিবছর ঢেউটিন আমদানি হতো। ১৯৭২-৭৩ সালে ২৯ হাজার ১৫৬ টন ঢেউটিন আমদানি হয়। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় বেসরকারি খাত মধ্যবর্তী কাঁচামাল থেকে ঢেউটিন উৎপাদনে যুক্ত হলে আমদানি কমে আসে।
নব্বইয়ের দশকে ঢেউটিনের চাহিদা বাড়তে থাকায় উদ্যোক্তারা বড় কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেন। ১৯৯৮ সাল থেকে চট্টগ্রামে ঢেউটিনের কাঁচামাল কোল্ড রোলড বা সিআর কয়েল তৈরির কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু হয়। ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে চট্টগ্রামের পাঁচটি শিল্প গ্রুপ—আবুল খায়ের, পিএইচপি, টি কে, কেডিএস এবং এস আলম বড় কারখানা চালু করে এ খাতে। পরে যুক্ত হয় আরএম এবং অ্যাপোলো ইস্পাতও, যে দুই কারখানা এখন বন্ধ। এসব কারখানা অপরিশোধিত ইস্পাত পাতের কয়েল আমদানি করে সেখান থেকে ঢেউটিনের কাঁচামাল পরিশোধিত ইস্পাতের পাত তৈরি করত।
বড় বড় শিল্প গ্রুপের বিশাল বিনিয়োগে গড়ে ওঠা এসব কারখানা ঢেউটিন খাতে নতুন নতুন পণ্য নিয়ে আসে। উৎপাদনে যুক্ত হয় স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া। রঙিন ঢেউটিন তৈরির মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ খাতে পণ্যের বৈচিত্র্য। শুরুতে জিংকের প্রলেপযুক্ত ঢেউটিন উৎপাদিত হলেও পরে চালু হয় জিংক ও অ্যালুমিনিয়ামের প্রলেপযুক্ত ঢেউটিন। আবার ইস্পাতের কাঠামোর কারখানা নির্মাণে বড় বড় ঢেউয়ের টিন বা প্রোফাইলও উৎপাদন শুরু করে বড় উদ্যোক্তারা।
জানতে চাইলে পিএইচপি ফ্যামিলির পরিচালক মোহাম্মদ আমির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, একসময় দেশে সাধারণ ঢেউটিন উৎপাদিত হলেও এখন বহুমুখী পণ্য তৈরি হচ্ছে। জিংক ও অ্যালুমিনিয়ামের প্রলেপযুক্ত ঢেউটিন, রঙিন ঢেউটিন, কারখানার ছাদ তৈরির প্রোফাইলসহ অনেক পণ্য তৈরি হচ্ছে। তাই পিএইচপি পরিবার এ খাতে ধারাবাহিক বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়েছে।
বড়দের পাশাপাশি ছোট গ্রুপগুলো এখনো ইস্পাতের পাত আমদানির পর তা দিয়ে ঢেউটিন তৈরি করে বাজারজাতও করছে। আবার সিআর কয়েল কারখানা থেকে পরিশোধিত ইস্পাতের পাত কিনেও ঢেউটিন বানাচ্ছে তারা।
বাংলাদেশ আয়রন মার্চেন্ট অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আমির হোসেন নুর আলী প্রথম আলোকে বলেন, সমিতির ১০০ সদস্য আছে, যারা ভবন নির্মাণের কাঠামোর পাশাপাশি ঢেউটিনও তৈরি করে। ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর হাত ধরে বছরে কয়েক লাখ টন ঢেউটিন বাজারজাত হচ্ছে।
অপরিশোধিত ইস্পাতের পাত থেকে ঢেউটিন তৈরিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে মূলত আবুল খায়ের ও পিএইচপি গ্রুপ। এ দুই গ্রুপের হাতেই মোট বাজারের ৭৫ শতাংশ অংশীদারত্ব। কেডিএস গ্রুপের কেওয়াইসিআর কয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ১৪ শতাংশ, টিকে গ্রুপ এবং এস আলম গ্রুপের হাতে ৫ শতাংশ করে বাজার অংশীদারত্ব রয়েছে।
গত তিন বছরে কাঁচামাল আমদানির তথ্যে দেখা যায়, এ সময় প্রতিবছর প্রায় সাড়ে চার লাখ টন করে কাঁচামাল আমদানি করেছে আবুল খায়ের গ্রুপ। পিএইচপি আমদানি করেছে গড়ে তিন লাখ টন করে। কেডিএস গ্রুপ গড়ে ১ লাখ ৪২ হাজার টন করে আমদানি করেছে। টিকে এবং এস আলম গ্রুপের আমদানি ৫০ হাজার টন করে। এ খাতে দুই মাস আগে উৎপাদনে এসেছে জালালাবাদ মেটাল লিমিটেড।
একসময় শুধু ঘরের চাল ও চারপাশে বেড়ার কাজে ব্যবহার করা হতো ঢেউটিন। গ্রামেগঞ্জে ছিল চাহিদা। এখন গ্রাম ছাড়িয়ে শহরেও চাহিদা বাড়ছে ঢেউটিনের। মেট্রোরেল, উড়ালসড়ক, টানেলের মতো প্রকল্প এলাকায় প্রকল্পের চারপাশ ঘেরাও করার জন্য দরকার হয় ঢেউটিন। নতুন করে বড় চাহিদা তৈরি হচ্ছে কারখানা ও শেড স্থাপনে। দ্রুত নির্মাণের জন্য ইস্পাতের কাঠামো ব্যবহৃত কারখানার সংখ্যা বাড়ছে। এসব কারখানায় ছাদ ও চারপাশ ঘেরাও করার জন্য দরকার শিল্পের ঢেউটিন বা প্রোফাইল। পণ্যের বহুমুখীকরণের কারণে বাজারও বড় হচ্ছে।
বিশ্ববাজারে ঢেউটিনশিল্পের কাঁচামাল পরিশোধিত-অপরিশোধিত ইস্পাত পাতের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয় গত অর্থবছর। গত অর্থবছরে কাঁচামাল আমদানির হিসাবে বছরে ১১ থেকে ১২ লাখ টন ঢেউটিন ও ঢেউটিনের সহযোগী পণ্য উৎপাদন করা হয়। উদ্যোক্তাদের হিসাবে এ খাতে বছরে বার্ষিক বেচাকেনা এখন ১৮ হাজার কোটি টাকা।
একসময় ঢেউটিন রপ্তানি হতো। স্থানীয় চাহিদা বাড়ায় এখন রপ্তানি কমে এসেছে। এরপরও প্রতিবেশী দেশগুলোয় কিছু ঢেউটিন রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে কেডিএস গ্রুপ। গত অর্থবছরে কেডিএস গ্রুপের কেওয়াইসিআর কয়েল ইন্ডাস্ট্রি ভারত ও সেন্ট বার্থেলামিতে ৮২ লাখ ৫৫ হাজার ডলারের ইস্পাতের পাতসহ ঢেউটিনপণ্য রপ্তানি করেছে। কেডিএস গ্রুপের এক কর্মকর্তা জানান, তাঁদের সিংহভাগ পণ্য রপ্তানি হচ্ছে ভারতে। এ ছাড়া দেশীয় রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের ঢেউয়ের টিন সরবরাহ করে প্রচ্ছন্ন রপ্তানি করছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
ফেনীর ছাগলনাইয়ায় পিএইচপির ইন্টিগ্রেটেড স্টিল মিল ঘুরে দেখা যায় কারখানার দুটি স্টোররুমে সারি সারি গোলাকার হট রোলড বা এইচআর কয়েল। ইস্পাতের পাতশিল্পে এটি মূলত মধ্যবর্তী কাঁচামাল। আকরিক লৌহ গলিয়ে তৈরি হয় এইচআর কয়েল। বাংলাদেশে এইচআর কয়েল তৈরির কারখানা নেই। ফলে এই কয়েল আমদানি করে পরিশোধিত ইস্পাতের পাত বা কোল্ড রোলড কয়েল তৈরি করা হয়।
উৎপাদনের প্রক্রিয়া দেখিয়ে কারখানার জ্যেষ্ঠ সহকারী মহাব্যবস্থাপক বিন্দু নাথ জানান, এইচআর কয়েল প্রথম ধাপে পরিশোধন করা হয়। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে এইচআর কয়েল খুলে পরিশোধন করে আবার কয়েল আকারে তৈরি করা হয়। সাধারণত ২ মিলিমিটার পুরুত্ব ও ৯২৫ মিলিমিটার প্রশস্ত এইচআর কয়েল আমদানি করে কারখানাগুলো। পরিশোধনের পর এইচআর কয়েলের পাত থেকে জং অপসারণ করা হয়। এরপর পরিচ্ছন্ন ইস্পাত পাতের কয়েল নেওয়া হয় কোল্ড রোলড বা সিআর কয়েল ইউনিটে। সেখানে রোলারের মাধ্যমে প্রচণ্ড চাপে মোটা পাত পাতলা করা হয়। প্রস্তুত পণ্য কতটুকু পাতলা হবে, সে অনুযায়ী ২ মিলিমিটার পুরুত্বের পাতকে দশমিক ১৫ থেকে দশমিক ৫১ মিলিমিটারে নামিয়ে আনা হয়। তৃতীয় ধাপে সিআর কয়েলের প্রশস্ততা সমান করার জন্য দুই পাশে কাটা হয়। ভাঁজ থাকলে সমান করা হয়। অর্থাৎ ঢেউটিনের প্রশস্ততা বজায় রাখা হয় এ ধাপে।
চতুর্থ ধাপে জিংক ও অ্যালুমিনিয়ামের প্রলেপ দেওয়ার জন্য পরিশোধিত ইস্পাতের পাত থেকে আবারও অক্সিজেনসহ অপ্রয়োজনীয় পদার্থ অপসারণ করা হয়। এরপরই ৪৮০ থেকে ৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় উত্তপ্ত অ্যালুমিনিয়াম ও জিংকের প্রলেপ দেওয়া হয় ইস্পাতের পাতে। এরপর কয়েলের মতো করা হয়। এই কয়েল আরেকটি যন্ত্রে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঢেউ দিয়ে ঢেউটিন তৈরি করা হয়। রঙিন ঢেউটিন তৈরি করার জন্য আরেক ধাপে রঙের প্রলেপ দিয়ে ঢেউ দেওয়া হয়।
১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সালে ঢেউটিন খাতে বড় বিনিয়োগ হয়। এরপর দীর্ঘ সময় এ খাতে বিনিয়োগ হয়নি। ঢেউটিন ছাড়িয়ে ইস্পাতের পাতশিল্পের পণ্য ব্যবহারের চাহিদা তৈরি হওয়ায় কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগ বাড়ছে এ খাতে।
গত জুলাই মাসে উৎপাদনে আসে জালালাবাদ মেটাল লিমিটেড। ২০ বছর ধরে পরিশোধিত ইস্পাতের পাত থেকে ঢেউটিন উৎপাদনে যুক্ত জালালাবাদ স্টিল এখন অপরিশোধিত ইস্পাতের পাত বা এইচআর কয়েল থেকে ঢেউটিন উৎপাদন শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠ উপমহাব্যবস্থাপক শওকত ওসমান প্রথম আলোকে বলেন, নতুন কারখানাটির বার্ষিক উৎপাদনের ক্ষমতা আড়াই লাখ টন।
পিএইচপি ফেনীতে নতুন কারখানা চালু করেছে ২০২০ সালে। সেখানে আরেকটি ইউনিট চালু করবে এ শিল্প গ্রুপ। গ্রুপটি বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে ৫০০ একর জায়গায় মৌলিক কারখানা গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এ কারখানায় মূল কাঁচামাল আকরিক লৌহ থেকে বছরে ১০ লাখ টন এইচআর কয়েল উৎপাদন করবে। তাতে এইচআর কয়েলে আমদানিনির্ভরতা কমে ঢেউটিনের পণ্যে বৈচিত্র্য আরও বাড়বে। এ কারখানায় সম্ভাব্য বিনিয়োগ ২০ হাজার কোটি টাকা।
ইস্পাতশিল্পকে বলা হয় মাতৃশিল্প। লং স্টিলে শুধু রড, চ্যানেল ও অ্যাঙ্গেলের মতো গুটিকয় পণ্য রয়েছে। তবে ফ্ল্যাট স্টিল বা ইস্পাতের পাতশিল্প থেকে হাজারো পণ্য তৈরি হয়। যেমন ভবন ও অবকাঠামো নির্মাণ, ইলেকট্রনিকস, মুঠোফোন, গাড়ি, শিল্পকারখানার যন্ত্রপাতি তৈরি হয় ইস্পাতের পাত থেকে। দেশে চাহিদা বেশি থাকায় ইস্পাতের পাতশিল্পগুলো এখন সবচেয়ে বেশি উৎপাদন করছে ঘর ও কারখানায় ব্যবহারের ঢেউটিন। এ খাতে বিনিয়োগ ও বৈচিত্র্য দুটোই বাড়ছে।