দেশের ৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ৪১ শতাংশ গত বছর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার বাইরে ছিল। ওই সময় অর্থাৎ ২০২৩ সালে তারা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী হিসেবে ছিল না। মোট জনসংখ্যার হিসাবে শিক্ষার বাইরে থাকা শিশু ও তরুণের এই সংখ্যা ২ কোটি ৬২ লাখের বেশি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত রোববার বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩-এর ফলাফল প্রকাশ করে। সেখানে শিক্ষাবহির্ভূত জনসংখ্যার বিষয়ে এ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনটি তৈরির জন্য বিবিএস ৩ লাখ ৮ হাজার ৩২টি পরিবারের ওপরে জরিপ পরিচালনা করে।
বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, শিক্ষাবহির্ভূত জনগোষ্ঠীর হার ২০২২ সালের তুলনায় খুব সামান্য কমেছে। তবে করোনার আগের সময়ের তুলনায় এই হার এখনো অনেক বেশি। মহামারির ঠিক আগে ২০১৯ সালে দেশে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমে না থাকা জনগোষ্ঠীর হার ছিল ২৯ দশমিক ২৭। সেই হিসাবে শিক্ষার বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর হার গত ৫ বছরে প্রায় ১১ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়েছে।
স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম প্রকল্পের পরিচালক আলমগীর হোসেন বলেন, সাধারণত ৫ থেকে ২৪ বছর হলো মানুষের শিক্ষাকালীন বয়স। এ সময়ে যেকোনো ব্যক্তির প্রাক্-প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত পড়াশোনার মধ্যে থাকার কথা। এই বয়সী মানুষের মধ্যে যারা কখনোই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায়নি কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়েছে, তাদের হিসাব দেখানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মহামারি এবং এর পরবর্তী বিভিন্ন আর্থসামাজিক কারণে শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ পড়ালেখা থেকে দূরে সরে গেছে। গত দুই বছরে সে অবস্থার তেমন উন্নতি ঘটেনি। লেখাপড়ার বাইরে থাকা শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
বিবিএসের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বর্তমানে দেশে ৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে ৫৯ দশমিক ২৮ শতাংশ শিক্ষায় রয়েছে, অর্থাৎ তারা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করছে। বাকি ৪০ দশমিক ৭২ শতাংশের কোনো শিক্ষার্থী পরিচয় নেই। অর্থাৎ তারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে রয়েছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১ জুলাই দেশে ৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী ৬ কোটি ৩৭ লাখ মানুষ ছিল। এর মানে গত বছর প্রায় ২ কোটি ৬২ লাখ শিশু ও তরুণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে ছিল।
তবে ২০২২ সালের তুলনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকা মানুষের হার অতি সামান্য কমেছে বলে জরিপে দেখা গেছে। ২০২২ সালে এই হার ছিল ৪০ দশমিক ৯১। এ ছাড়া ড্রপআউট বা শিক্ষা অসমাপ্ত রেখে লেখাপড়া ছাড়ার হারও কমেছে। বিবিএস জানায়, ২০২২ সালে ৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ড্রপআউটের হার ছিল ১০ দশমিক ৫৮, যা গত বছর কমে ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ হয়েছে। আর মহামারির আগের বছর ২০১৯ সালে ড্রপআউটের হার ছিল মাত্র ৩ দশমিক ১।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ মনজুর আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, করোনা মহামারির ধাক্কায় অনেক শিক্ষার্থী পড়ালেখা থেকে দূরে সরে যায়। এ ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মানুষের ওপর অর্থনৈতিক চাপ ও বৈষম্য বাড়ছে; এর বিপরীতে কমেছে শিক্ষার সুযোগ। এ কারণে বিপুল পরিমাণে শিক্ষার্থী পড়ালেখার বাইরে থাকবে—এটা প্রত্যাশিত।
তবে শিক্ষার বাইরে থাকা জনগণকে শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনতে সরকারের প্রচেষ্টার ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন মনজুর আহমদ। তিনি বলেন, ‘সরকার শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনার জোরালো উদ্যোগ না নিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম চালুর বিষয়ে বেশি মনোযোগী হয়েছে। এ ধরনের খণ্ডিত পদক্ষেপে বিপদের ঝুঁকি বাড়তে পারে। এ পরিস্থিতি উত্তরণে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ ও সুযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি দুর্নীতি কমানো, জবাবদিহি নিশ্চিত করা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে জোর দেওয়া প্রয়োজন।’
বিবিএসের স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩ প্রতিবেদনে শিক্ষা খাতসংক্রান্ত আরও কিছু তথ্য এসেছে, যেমন বর্তমানে ৭ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে সাক্ষরতার হার প্রায় ৭৮, যা ২০২২ সালের তুলনায় ১ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি। সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের মধ্যে পুরুষ ৮০ শতাংশ ও নারী প্রায় ৭৬ শতাংশ।
এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯১ শতাংশ সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা, ৭ দশমিক ২৯ শতাংশ ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা এবং ১ দশমিক ২২ শতাংশ কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থায় যুক্ত রয়েছে। আর শিক্ষা, কর্ম বা প্রশিক্ষণে যুক্ত নেই—এমন তরুণের (১৫-২৪ বছর) হার প্রায় ৩৯ দশমিক ৮৮।