বিদেশে মেলা বা প্রদর্শনী আয়োজন নিয়ে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোতে (ইপিবি) বহু বছর ধরেই অব্যবস্থাপনা চলছে। বিশেষ করে এ এইচ এম আহসান যখন সংস্থাটির ভাইস চেয়ারম্যান (ভিসি) ছিলেন, তখন তাঁর পুরো সময়েই ছিল এ রকম অব্যবস্থাপনা। তিনি দায়িত্বে ছিলেন ৪ বছর ২ মাস। দুই মাস আগে সংস্থাটিতে নতুন ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ার হোসেন। তিনিও আগেকার অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে অবগত আছেন।
ইপিবির আন্তর্জাতিক মেলা ও প্রদর্শনী বিভাগের উপপরিচালক (ডিডি) আবু মোখলেছ আলমগীর হোসেনের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর একটি হলো মার্কিন ডলারে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ। গত বছরের ১৬ থেকে ২০ আগস্ট চীনের কুনমিংয়ে অনুষ্ঠিত চার দিনব্যাপী সপ্তম চায়না দক্ষিণ এশিয়া এক্সপো ও ২৭তম চায়না আমদানি-রপ্তানি মেলায় অংশ নেওয়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তিনি ১৫০ ডলার করে ঘুষ নিয়েছেন। এ ছাড়া সবার কাছ থেকে তিনি নগদে দুই হাজার টাকা করে ঘুষ নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ইপিবি সাধারণত মেলায় অংশগ্রহণকারী কারও কাছ থেকে নগদ টাকা নেয় না; কিন্তু চীনের ওই মেলায় অংশ নেওয়ার বিপরীতে ইপিবিও প্রজ্ঞাপন জারি করে সবার কাছ থেকে জামানতের নামে ১০ হাজার টাকা করে নিয়েছে। মেলাটিতে দেশের ১৮টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সৃষ্টি, লিজা বুটিকস, আলাস্কা ফ্যাশন, ইউটেক্স ইন্টারন্যাশনাল, বাবু লেদার, আসমা বুটিক অ্যান্ড হ্যান্ডক্রাফট, আই ওয়ার্ল্ড ফ্যাশন, এম এস হাওলাদার ট্রেডিং, মিয়া ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, আস্থা হ্যান্ডক্র্যাফট, ওয়িং অ্যাপারেলস, পপিস ট্রেডিং, মাদানি ফ্যাশন ওয়্যার, হুর ক্র্যাফটস, অহন ট্রেডার্স, বাংলা লেদার, আনছারি ক্রিয়েশন ও ক্যাপটেন চারকোল ইন্ডাস্ট্রি।
আবু মোখলেছ আলমগীর হোসেন ইপিবির আন্তর্জাতিক মেলা ও প্রদর্শনী বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন পাঁচ বছর। তিনি সংস্থাটির উপপরিচালক (ডিডি) হয়েও নিজেকে পরিচালক হিসেবে পরিচয় দেন। এর প্রমাণ ইপিবির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত মেলার প্রজ্ঞাপনেও দেখা গেছে।
মেলায় অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বত্বাধিকারীরা জানান, মেলা শেষে তাঁরা বহুবার ধরনা দিয়েও আলমগীর হোসেনের কাছ থেকে জামানতের টাকা ও ডলার ফেরত পাননি। তাঁরা ইপিবির সাবেক ভিসি এ এইচ এম আহসানকেও বিষয়টি জানিয়েছেন। ইপিবিতে পুরো বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট’ বলে জানা গেছে।
লিজা বুটিকসের স্বত্বাধিকারী এলিজা পারভীন প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, ‘ইপিবির ডিডি আবু মোখলেছ আলমগীর হোসেনকে দিতে হবে বলে আমার কাছ থেকে ১৫০ ডলার নিয়েছেন নাজমুল আলম ওরফে কচি নামের এক ব্যক্তি। সে ডলার মেলা শেষে ফেরত দেওয়ার কথা; কিন্তু তা আর ফেরত পাইনি।’
সৃষ্টির স্বত্বাধিকারী সৈয়দা আনোয়ারা বেগম জানান, তিনিও ১৫০ ডলার দিয়েছেন। তবে চাপ দিয়ে তিনি এ ডলার ফেরত নিতে পেরেছেন। বাংলা লেদারের স্বত্বাধিকারী আজিজুর রহমান বলেন, ‘আমার কাছ থেকে শুধু ১৫০ ডলার নয়, নগদেও দুই হাজার টাকা নিয়েছেন। কিছুই ফেরত পাইনি।’
মেলায় অংশ নেওয়া আরও সাতজনের সঙ্গে কথা হয়েছে প্রথম আলোর। সবার অভিযোগ, তাঁদের প্রত্যেককেই ১৫০ ডলার ঘুষ দিতে হয়েছে।
ডলারে ঘুষ নেওয়ার বিষয়ে আবু মোখলেছ আলমগীর হোসেনের সঙ্গে তাঁর ইপিবির কার্যালয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, জামানত হিসেবে ডলার নেওয়া হয়। এ ব্যাপারে চীনের সঙ্গে চুক্তি ছিল বলে তিনি দাবি করেন। তাঁর সরবরাহ করা চুক্তির একাংশে ১৫০ ডলারের কথা উল্লেখ থাকলেও ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান (ভিসি) এ এইচ এম আহসান নিজেই বলেন, এ চুক্তি ভুয়া হতে পারে। কারণ, ইপিবি কারও সঙ্গেই এ ধরনের চুক্তি করতে পারে না।
বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইপিবির ডিডি আবু মোখলেছ আলমগীর হোসেনকে গত ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মেলা ও প্রদর্শনী বিভাগ থেকে নীতি বিভাগে বদলি করা হয়। কিন্তু নতুন বিভাগে যাওয়ার আগে তিনি একাই ১৪টি মেলার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়ে যান। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের অনুমোদন পায় সেটকো বাংলাদেশ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এটির স্বত্বাধিকারী নাজিম হোসেন ওরফে ডলার সম্পর্কে আলমগীর হোসেনের আত্মীয়। মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও নাজিম হোসেন ডলারকে পাওয়া যায়নি। খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠালেও তিনি কোনো জবাব দেননি।
আজ রোববার সচিবালয়ে ইপিবির পর্ষদ বৈঠক। এতে সভাপতিত্ব করবেন ইপিবির পর্ষদ চেয়ারম্যান অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। সংস্থাটির ভিসি আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল বৈঠকে যোগ দেবে। এতে ইপিবির সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা।
ইপিবি যেভাবে ক্ষতিপূরণ দিল
২০২০ সালে দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ কান্ট্রি প্যাভিলিয়ন’ শীর্ষক মেলায় অংশ নিতে আবেদন করেছিল সাফা ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তা অনুমোদন করেনি। কিন্তু এরপর গোপনে প্রতিষ্ঠানটিকে অনুমোদন দেন আলমগীর হোসেন। ফলে সাফা ইন্টারন্যাশনাল অনেক কর্মী নিয়ে দুবাই যায়, অনেক পণ্যও পাঠায়। কিন্তু দুবাই গিয়ে প্রতিষ্ঠানটি দেখতে পায় তাদের নামে মেলায় কোনো প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ নেই।
পরে ইপিবির কাছে ৫০ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করে সাফা ইন্টারন্যাশনাল। তখন তাদের প্রায় কোটি টাকার পণ্য সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের মাধ্যমে ফেরত এনে দেয় ইপিবি। আলমগীর হোসেন ও এজেন্ট মিলে এ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে আবু মোখলেছ আলমগীর হোসেন প্রথম আলোর কাছে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে ইপিবির সাবেক ভিসি এ এইচ এম আহসান বলেন, কিছু জটিলতা হয়েছিল, যা পরে মিটে গেছে।
নেপালে যা হতে যাচ্ছিল
নেপালের কাঠমান্ডুতে ‘সেফকন কাঠমান্ডু এক্সিবিশন ২০২৪’ শীর্ষক নির্মাণসামগ্রীর মেলা আয়োজন করে সেভর ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এ বছরের ২৩–২৫ ফেব্রুয়ারি এ মেলা করার জন্য গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। মেলাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সূত্রে জানা গেছে, সেভর ইন্টারন্যাশনাল নামে নেপালে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এটি মূলত বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান। পরে অবশ্য আলমগীর হোসেন মেলাটি বাতিল করে দেন। এ মেলা নিয়ে আলমগীর হোসেন বলেন, মেলা তো বাতিল করা হয়েছে। এটা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কী মানে আছে।
ইপিবির দায়িত্বশীল অন্য কর্মকর্তারা অবশ্য আবু মোখলেছ আলমগীর হোসেনের অনিয়মসহ পুরো বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হস্তক্ষেপ চান।
ইপিবির নতুন ভিসি আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সার্বিক বিষয়ে খোঁজ নেবেন এবং এরপর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। তবে এ সংস্থায় কোনো দুর্নীতি তিনি হতে দেবেন না।