ঢাকার অনেক বাজার ও দোকানে গরুর মাংস প্রতি কেজি ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিছু দোকানে এর চেয়েও কম দামে গরুর মাংস পাওয়া যাচ্ছে। অতিরিক্ত দাম হওয়ার কারণে যাঁরা অনেক দিন গরুর মাংস কেনেননি, তাঁদের অনেকেই এখন মাংসের দোকানে ভিড় জমাচ্ছেন। তবে তুলনামূলক এই কম দামে গরুর মাংস আর কত দিন বিক্রি করা যাবে, সে ব্যাপারে বিক্রেতারা নিশ্চিত নন।
বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত মার্চে গরুর মাংসের দাম ৮০০ টাকায় উঠেছিল। বিক্রেতারা বলছেন, কম দামে গরু পাওয়ার কারণে তাঁরা এখন আগের চেয়ে কম দামে মাংস বিক্রি করতে পারছেন।
খামারি, গরু ব্যবসায়ী, কসাই ও ক্রেতা—সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে অনেক দিন ধরেই গরুর মাংসের দাম বেশি থাকায় বেচাকেনা অনেক পড়ে গিয়েছিল। তবে মাংসের দাম কমে আসায় এখন আগের তুলনায় বেচাবিক্রি অনেকটাই বেড়েছে। দাম কমায় ক্রেতারাও খুশি। তবে কম দামের মাংসের মান নিয়ে অনেকের প্রশ্ন রয়েছে। আবার যেহেতু সব বাজারে গরুর মাংস ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে না, তাই অনেকে খানিকটা বিভ্রান্তও হচ্ছেন।
বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মোর্তুজা প্রথম আলোকে বলেন, মূলত মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে আসার কারণে বাজারে হঠাৎ মাংসের চাহিদা কমে গিয়েছিল। এ কারণে ব্যবসায় টিকে থাকা নিয়েই শঙ্কায় পড়ে যান বিক্রেতারা। ঠিক এ সময়েই খামার থেকে আগের চেয়ে কম দামে গরু ছাড়া হয়েছে। সব মিলিয়েই মাংসের দাম কিছুটা নেমে এসেছে।
তবে বাজারের এ পরিস্থিতি কত সময় ধরে থাকবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত নন গোলাম মোর্তুজা। তিনি বলেন, ‘গরুর মাংসের কম দাম অব্যাহত থাকবে কি না, তা নির্ভর করছে কত দিন খামার থেকে কম দামে গরু আসবে তার ওপর। কম দামে খামার থেকে আসা গরুর সংখ্যা ইতিমধ্যেই কমে আসছে।’
মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আরও মনে করেন, বাজারে মাংসের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে গরুর উৎপাদন খরচে লাগাম টানতে হবে, অথবা বিদেশ থেকে গরু আমদানি করতে হবে। কিন্তু খামারিদের সুরক্ষা দেওয়ার বিবেচনায় গরু বা গরুর মাংস আমদানি করার সিদ্ধান্ত নেই। তবে স্থানীয়ভাবে গরুর দাম আবার বেড়ে গেলে ভারত থেকে চোরাই পথে গরু আনার চেষ্টা করবে এক শ্রেণি। এ নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
কুষ্টিয়ার প্রবীণ খামারি কাজী খামারের প্রতিষ্ঠাতা কাজী শওকত গরুর দাম কমার বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উৎপাদন খরচের বিষয়টি উল্লেখ করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গোখাদ্যের দাম বেশি হওয়ার পাশাপাশি খামারিরা নানা কারণে চাপে আছেন। তাতে একটু কম দামে গরু বিক্রি করে অনেকে চালান টেকানোর চেষ্টা করছেন। এর কারণে দাম একটু কমেছে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে খামারিরা এটা করতে চাইবেন না।’
ভারতে গরুর দাম কম—এ কথা জানিয়ে কাজী শওকত বলেন, চোরাই পথে দেশে গরু এলে তা খামারিদের বিপদে ফেলবে।
তবে গরুর বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে খামারিদের চেয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব বেশি বলে মনে করেন এ ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে। তাঁদের মতে, চাহিদা কমে ব্যবসা খানিকটা মন্দা হওয়ার কারণে এই মধ্যস্বত্বভোগীরা এখন একটু ছাড় দিচ্ছে। তবে গোষ্ঠীটি সুযোগ পেলে দাম বাড়ায়, বিশেষ করে তারা পবিত্র শবে বরাত বা রমজান মাসের মতো সময়কে কেন্দ্র করে গরুর মাংসের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করে। তবে দাম অতিরিক্ত হওয়া বা বেশি কমে যাওয়া শেষ পর্যন্ত বাজারকেই ক্ষতি করে।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনর (বিডিএফএ) সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান প্রথম আলোকে বলেন, দাম অস্বাভাবিক নেমে এলে সেটা ভালো কিছু না। কারণ, খামারিদের উৎপাদন খরচ বেশি। কিছু গরু কম দামে বাজারে আসার মানে হলো তাঁরাই গরু বিক্রি করছেন, যাঁরা টিকতে পারছেন না। এই সময়ে কম দামে অনেক ক্রেতা ১০ থেকে ২০ কেজি মাংস কিনে ফ্রিজে রেখে দেবেন। এ কারণে কিছুদিন পর কসাই আর ক্রেতা পাবেন না। তখন তিনি আবার আগের দামে ফিরে যেতে চাইবেন।
ডেইরি খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গরুর উৎপাদন আগের মতোই আছে। তবে সবশেষ কোরবানিতে গরু বেশ অবিক্রীত থেকে গিয়েছিল। গরু বিক্রি করতে না পারায় দায় টানছেন অনেক খামারি। আবার শীতের আগে নানা কারণে গরুর স্বাস্থ্যহানি ঘটে, শরীরে মাংস বাড়ে না। গরুর রোগাক্রান্ত হওয়ার হারও এই মৌসুমে বেশি। চাহিদা থাকায় অনেক খামারি তাদের কিছু গরু বাজারে ছেড়ে দিচ্ছেন।
যশোরের খামারি মতিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ৪০টি গরুর মধ্যে ৫টি বিক্রি করেছি। উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় আর বিক্রিতে আগ্রহ নেই। আবার দীর্ঘ মেয়াদে এত গরু পালাও সম্ভব নয়। তাতে লোকসান বাড়বে। কারণ, সুস্থ ও স্বাভাবিক গরু থেকে মাংসের উৎপাদন খরচ এখন কেজিপ্রতি ৬০০ টাকার ওপরে।’
গরুর মাংসের দাম দীর্ঘ মেয়াদে কমাতে হলে গোখাদ্যের দামে কমানো প্রয়োজন বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী।
তবে রোগের প্রাদুর্ভাবে গরু বিক্রি বেড়েছে—এমন কোনো তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রাণিস্বাস্থ্য শাখার উপপরিচালক শেখ শাহিনুর ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গরুর স্বাভাবিক যেসব রোগবালাই হয়, সেগুলোই দেখা যাচ্ছে। অনেক গরু রোগাক্রান্ত হচ্ছে বা নতুন কোনো রোগ এসেছে—এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে মাংসের উৎপাদন ছিল ৮৭ লাখ টন। ওই বছর দেশের বাজারে মাংসের চাহিদা ছিল ৭৬ লাখ টন। ফলে চাহিদার তুলনায় ১১ লাখ টন বেশি মাংস উৎপাদিত হয়েছে। তবে এই মাংসের একটি বড় অংশের উৎপাদন ও ভোগ হয় ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন, নিজস্ব প্রতিবেদক, কুষ্টিয়া ও যশোর অফিস]