রাজধানী ঢাকায় ওএমএস বা খোলাবাজারে বিক্রি কার্যক্রমের আওতায় আলু, ডিম, পেঁয়াজ, পটোলসহ কয়েকটি কৃষিপণ্য বিক্রি শুরু হয়েছে। সরকারি এ কর্মসূচি চালুর পর গত দুই দিনে ভোক্তাদের, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে এটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ট্রাকের পেছনে লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে কম দামে সবজি কিনছেন মানুষেরা।
প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে বাজারে সবজি, ডিমসহ বেশির ভাগ নিত্যপণ্য চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বড় ধরনের চাপে রয়েছেন সাধারণ মানুষ। এ অবস্থায় সরকার আমদানি শুল্ক কমানো, বাজার তদারকিসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এই প্রথমবারের মতো ওএমএসের মাধ্যমে কৃষিপণ্য বিক্রি শুরু করেছে সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর সচিবালয় এলাকায় কৃষিপণ্যের ওএমএস কর্মসূচি উদ্বোধন করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এদিন রাজধানীর ২০টি স্থানে ট্রাকে করে বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য বিক্রি করা হয়। আজ বুধবার ট্রাকের সংখ্যা আরও চারটি বাড়ানো হয়েছে।
কর্মকর্তাদের হিসাবে, গত দুই দিনে ১০ হাজারের বেশি মানুষ সাশ্রয়ী মূল্যের এসব পণ্য সংগ্রহ করেছেন। ভোক্তারা বলছেন, দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে কমে না আসা পর্যন্ত এ কর্মসূচি চালু রাখা এবং এর পরিধি আরও বাড়ানো প্রয়োজন।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, আগামী দুই সপ্তাহ পাইলট বা পরীক্ষামূলকভাবে এ বিক্রয় কার্যক্রম চালানো হবে। এই প্রকল্প সফল হয়ে সবজি বিক্রির স্থান ও পরিমাণ বাড়ানো হবে।
সরেজমিন যা দেখা গেল
আজ রাজধানীর ২৪টি স্থানে ওএমএস কর্মসূচির আওতায় কৃষিপণ্য বিক্রি করা হয়। এসব স্থানের মধ্যে মিরপুর–১০, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও রায়েরবাজার এলাকা ঘুরে দেখেন প্রথম আলোর দুজন প্রতিবেদক ও ফটোগ্রাফার। তিনটি স্থানেই ট্রাকের পেছনে মানুষের মোটামুটি লম্বা সারি ছিল। দিনমজুর, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, শিক্ষার্থী ও গৃহিণীদের পণ্য কেনার সারিতে দাঁড়াতে দেখা গেছে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে পণ্য কিনতে এসেছিলেন।
মিরপুর–১০ এলাকায় আজ সকাল সাড়ে নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ট্রাকে করে পণ্য বিক্রি হয়েছে। বেলা ১১টার দিকে সেখানে যান এই প্রতিবেদক। এ সময়ের মধ্যে ৪২ জন সেখান থেকে পণ্য কিনেছেন। এ ছাড়া অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ আলাদা সারিতে দাঁড়িয়ে পণ্য কেনার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন।
সেখানে কথা হয় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক আবদুল মালেকের সঙ্গে। সকালে তিনি অফিসের উদ্দেশে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলেন। আবদুল মালেক বলেন, ‘বাজারে সবজির দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ডিমের দামও অনেক। তাই এখানে কম দামে সবজি বিক্রি হতে দেখে গাড়ি থামিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। অফিসের স্যারকে বলেছি, আসতে একটু দেরি হবে।’
আবদুল মালেকের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন মিরপুর এলাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী শরীফুল ইসলাম। তিনিও অফিস থেকে এক ঘণ্টার ছুটি নিয়ে এসেছেন। শরীফুল বলেন, ‘বর্তমানে সময়ের চেয়েও অর্থ সাশ্রয় করা আমার কাছে বেশি প্রয়োজন। এ কারণে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এসেছি।’
মিরপুর-১০ এলাকা থেকে দুপুর ১২টার দিকে সংসদ ভবনের বিপরীতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে যান এই প্রতিবেদক। এ সময় সেখানে শতাধিক মানুষ পণ্য কেনার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রায় একই সময়ে রাজধানীর রায়েরবাজারে অবস্থিত বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধের কাছে থাকা ট্রাকের পেছনেও প্রায় ২০০ লোক অপেক্ষায় ছিলেন। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর ট্রাক থেকে ডিম, পেঁপে, আলু ও পেঁয়াজ কেনেন ষাটোর্ধ্ব দিনমজুর নাসিমা আক্তার। তিনি বলেন, ‘অহন আর দোকান থাইকা কিননা খাইতাম পারি না; বাকিতেও দেয় না। এইহান থেকে কমে কেনায় আমাগো অনেক উপকার হইছে।’
ওএমএসের কৃষিপণ্য নিতে আসা বেশ কয়েকজন ক্রেতা প্রথম আলোকে বলেন, এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। তবে এভাবে ট্রাক থেকে তো সব সময় পণ্য কেনা সম্ভব না। তাই সরকার যেন দ্রুত নিত্যপণ্যের দাম কমানোর উদ্যোগ নেয়।
দাম কতটা সাশ্রয় হচ্ছে
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জানায়, ওএমএস ট্রাক থেকে ভোক্তারা প্রতি কেজি করলা ৪০, পেঁয়াজ ৭০, আলু ৩০, কাঁচা পেঁপে ও শসা ২০ টাকায় কিনতে পারছেন। এই দরে একজন সর্বোচ্চ এক কেজি করলা, দুই কেজি পেঁয়াজ, পাঁচ কেজি আলু, দুই কেজি পেঁপে ও এক কেজি শসা পাচ্ছেন। এ ছাড়া ১৩০ টাকা দরে এক ডজন ডিমও কেনা যায়। তাতে ছয়টি পণ্যের প্যাকেজে সব মিলিয়ে লাগছে ৫২০ টাকা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভোক্তাদের সব কটি পণ্য কিনতে দেখা গেছে। তবে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ছিল ডিমের।
বাইরের বাজার থেকে এসব পণ্য কিনলে অন্তত ৯১০-৯৭০ টাকা প্রয়োজন হতো। আজ রাজধানীর শেওড়াপাড়া, মগবাজার ও মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে প্রতি কেজি করলা ৮০-১০০ টাকা, পেঁয়াজ ১১৫-১২০, আলু ৬০, পেঁপে ৪০ ও শসা ৬০-৮০ টাকায় এবং এক ডজন ডিম ১৬০-১৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ ট্রাক থেকে একই পরিমাণ পণ্য একজন গ্রাহক ৪০০-৪৫০ টাকা কমে কিনতে পারছেন।
মিরপুর–২ এলাকার একটি টিনশেডের বাসায় ছেলে, মেয়ে ও দুই নাতিকে নিয়ে থাকেন আসিয়া বেগম। বাসার পাশের একজনের কাছ থেকে খবর পেয়ে আজ মিরপর–১০–এ ট্রাক থেকে সবজি ও ডিম কিনতে আসেন তিনি। আসিয়া বেগম বলেন, ‘এখান থেকে ৫২০ টাকায় ডিমসহ ছয় ধরনের সবজি কিনেছি। এতে অন্তত ৪০০ টাকা বেঁচে গেছে।’
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ট্রাকে বিক্রি করা সবজিগুলো পণ্যের উৎপাদনস্থল বা হিমাগার পর্যায় থেকে সরাসরি আনা হচ্ছে। যেমন মুন্সিগঞ্জের হিমাগার থেকে আলু, পাবনা ও ফরিদপুর থেকে পেঁয়াজ এনে বিক্রি করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দামে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। যেমন হিমাগার থেকে প্রতি কেজি আলু ৪০ টাকায় কিনে, তা ৩০ টাকা দামে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। গ্রাহকেরা এক বা একাধিক প্যাকেজ আকারে এসব পণ্য কিনতে পারছেন। তবে শুধু একটি বা দুটি পণ্য কেনাকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিম জানান, বর্তমানে দিনে ৮–১০ হাজার নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে তাঁরা ভর্তুকি মূল্যে কৃষিপণ্য বিক্রি করছেন। সপ্তাহের সাত দিনই পণ্য বিক্রি করা হবে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না আসা পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলবে। কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা দুই দিনেই ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। এখন সারা দেশে পর্যায়ক্রমে এ কর্মসূচি সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।’