ঢাকা চেম্বারের সেমিনারে তাঁরা বলেন, শুধু প্রবাসী আয়, দাতাদের ঋণ ও সহায়তায় দেশ চলবে না। ব্যবসায়ীদেরও সব ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতারা ব্যবসার পরিবেশের দ্রুত উন্নতি চান। তাঁরা বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শিল্পাঞ্চলে অসন্তোষের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা কারখানায় যেতে ভয় পাচ্ছেন। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহারের কারণে ব্যবসায়ীরা দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সরবরাহ ব্যবস্থাপনার অস্থিতিশীলতায় বেসরকারি খাত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে আছে। গ্যাসের সংকটের কারণেও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এসব সমস্যার সমাধান না হলে নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি থমকে যাবে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ’ শীর্ষক সেমিনারে এ কথাগুলো বলেন ব্যবসায়ী নেতারা। গতকাল শনিবার রাজধানীর মতিঝিলে ঢাকা চেম্বার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এ সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি আশরাফ আহমেদ।
সেমিনারে ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, শুধু প্রবাসী আয়, দাতাদের ঋণ ও সহায়তায় দেশ চলবে না। ব্যবসায়ীদেরও সব ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাঁদের (ব্যবসায়ীদের) কথা বলার একটা জায়গা লাগবে। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর পরামর্শ দেন তাঁরা।
ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, ভালো ব্যাংকগুলোয় তারল্যসংকট আছে। ফলে উদ্যোক্তারা প্রত্যাশিত মাত্রায় ঋণ পাচ্ছেন না। কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার কারণে পণ্য উৎপাদন ব্যাহত করছে। এ ছাড়া শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়নে স্বল্পমূল্যে আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
প্রশাসন পুরোপুরি কাজ করছে না—এমন অভিযোগ করেন মেট্রো চেম্বারের সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। তিনি বলেন, প্রশাসন পুরোপুরি কাজ করছে না। চাকরি থাকবে কি থাকবে না, নতুন করে আবার কী বের হয়ে আসে—এমন সব কারণে কাজ করতে চাইছেন না অনেকে। ফলে সরকারকে দৃঢ়তার সঙ্গে কর্মকর্তাদের বার্তা দিতে হবে।
শিল্পাঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘আমরা কষ্টে আছি। আজকে আমার কারখানায় যেতে ভয় লাগে। ভয় লাগে এই জন্য যে আমি কি নিজের জীবন নিয়ে বের হয়ে আসতে পারব? এভাবে ব্যবসায়ীরা যদি নিজেদের কারখানায় যেতে শঙ্কিত হন, তাহলে তাঁরা আগামী দিনে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবেন না।’
যারা শিল্পাঞ্চলে অসন্তোষ উসকে দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দাবি জানিয়ে আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘যারা আইনশৃঙ্খলার বর্তমান দুর্বল পরিস্থিতিতে অন্যায় সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে, তাদের শিক্ষা দিতে হবে। আমাদের দেশে কখনোই ‘দিতে হবে, দিতে হবে’; ‘দাবি মানতে হবে’ এমন সংস্কৃতি ছিল না। আমরা বিগত দিনে কারখানাগুলোতে শান্তিপূর্ণভাবে কাজে করেছি। আমরা সেই সংস্কৃতি ফিরে পেতে চাই।’
চলমান শ্রমিক অসন্তোষে অনুপ্রবেশকারীদের হাত রয়েছে বলে মন্তব্য করেন নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বড় সমস্যা হলো গ্যাসের সংকট। আমরা গ্যাসের অভাবে সময়মতো পণ্য উৎপাদন করতে পারছি না।’
তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক শামস মাহমুদ বলেন, ‘তৈরি পোশাকের ভরা মৌসুম ডিসেম্বরে। অথচ ক্রেতারা ইতিমধ্যে ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিয়েছে। তাই আমাদের ভাবতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে।’
সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘ঠিক জায়গায় ঠিক লোক বসালে ভালো ফল দেয়। এ সরকারের আমলে সেই প্রমাণ পাচ্ছি। ইতিমধ্যে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাসী আয় আসা বেড়েছে। বিনিময় হার অনেকটাই স্থিতিশীল হয়েছে। বর্তমান গভর্নরের ওপর ব্যবসায়ীদের আস্থা আছে। তবে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় নিরাপত্তাহীনতায় আছে। গাজীপুর ও সাভারের আশুলিয়ায় শ্রম অসন্তোষের নামে দুর্বৃত্তায়ন চলছে। এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি থাকলে নতুন কর্মসংস্থানে কীভাবে হবে?’
গত তিন মাসে ভোক্তাদের ব্যয় করার প্রবণতা কমেছে বলে জানান মাস্টার কার্ড বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল। তিনি বলেন, ডিজিটাল লেনদেন গত জুলাইয়ে ৪০ শতাংশ কমে যায়। দুর্গাপূজার কেনাকাটার জন্য সেপ্টেম্বরে কিছুটা বেড়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে মানুষ ব্যয় কমিয়ে দিয়েছেন। তবে তাঁদের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা বেড়েছে।
ফুডপ্যান্ডা বাংলাদেশের সহপ্রতিষ্ঠাতা আমব্রিন রেজা বলেন, গত তিন মাসে ডিজিটাল ব্যবসা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো বড় কয়েকটি ছাড়া বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের বিক্রি জুলাইয়ের আগের অবস্থানে আসেনি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের কম সুদে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে জোর দেন তিনি।
বিদেশি ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে বলে মন্তব্য করেন বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ। তিনি বলেন, সরকার ব্যাংক খাত সংস্কারে নজর দিয়েছে। তবে অন্যান্য জায়গায় এখনো নজর দেওয়া হয়নি। এমনটি হলে আস্থা আসবে না। এ ছাড়া ছয় মাসের মধ্যে ঋণ বা সহায়তার মাধ্যমে রিজার্ভে ছয়-আট বিলিয়ন যুক্ত করতে হবে, তাহলে আমদানির ওপর বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া সহজ হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংস্কারে জোর দেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন। তিনি বলেন, কাস্টমস হাউসগুলোর দুর্নীতির কারণে ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সংস্থাটির সংস্কার জরুরি। বর্তমান সরকার এখনো ব্যবসায়ীদের আস্থা অর্জন করতে পারেনি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
অর্থায়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়ার কথা বলেন সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। তিনি বলেন, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বন্ধ। তবে এফডিআই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ডলারের জন্য নয়, বিদেশি বিনিয়োগ এলে বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থায় যুক্ত থাকা যায়। রপ্তানি পণ্যের বাড়তি দাম পাওয়া যায়। বর্তমানে যেসব বিদেশি প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের সমস্যাগুলো সমাধান করলেই বিদেশি বিনিয়োগের দরজা খুলবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।