অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে গতকাল সচিবালয়ে আইএমএফের স্টাফ কনসালটেশন মিশন বৈঠক করে।
দেশের অর্থনীতি বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে ভুগছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। খেলাপি ও অবলোপন থেকে আদায়ও তেমন হচ্ছে না। আবার ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো থেকে আমানত সরিয়ে নিচ্ছেন গ্রাহকেরা। ব্যাংক তথা আর্থিক খাতের জন্য যে পাঁচ আইন করতে হবে, সেগুলোর একটি মাত্র মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন পেয়েছে, বাকিগুলোর খসড়া আছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতায়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ গতকাল বুধবার সচিবালয়ে আইএমএফের ঢাকা সফরকারী স্টাফ কনসালটেশন মিশনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এমন চিত্রই তুলে ধরেছে। মিশনটি গত মঙ্গলবার থেকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করছে, যা চলবে আগামী ২ মে পর্যন্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তিন বিভাগ এবং রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালীসহ ছয় ব্যাংকের প্রতিনিধিদের নিয়ে মিশনটির সঙ্গে এ বৈঠক করেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ। বৈঠক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশের জন্য গত জানুয়ারিতে আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের শর্তের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। আইএমএফ মিশনকে জানানো হয়েছে, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএলের ঋণ ও অগ্রিম রয়েছে ২ লাখ ৭৮ হাজার ৪২২ কোটি টাকা। এর মধ্যে তাদের খেলাপি ঋণ ৫৬ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি বেসিক ব্যাংকের—৫৮ শতাংশ, আর সবচেয়ে কম সোনালী ব্যাংকের—১৫ শতাংশ। ছয় ব্যাংকের গড় খেলাপি হার দ্বিগুণের বেশি অর্থাৎ ২০ দশমিক ২৭ শতাংশ।
পুরো ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ২০২০ সালে ৭ দশমিক ৬৬, ২০২১ সালে ৭ দশমিক ৯৩ এবং ২০২২ সালে বেড়ে তা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ হয়েছে বলে আইএমএফকে জানানো হয়।
খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখা বাধ্যতামূলক। সোনালী, জনতা ও বিডিবিএল বাড়তি সঞ্চিতি রাখতে পারলেও বাকি তিন ব্যাংকই ঘাটতিতে রয়েছে। যেমন অগ্রণীর ৪ হাজার ৪২২ কোটি, রূপালীর ২ হাজার ৮১৫ কোটি এবং বেসিক ব্যাংকের ৪ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে। আর বেসিক ব্যাংক ১২৭ কোটি টাকা লোকসানে থাকলেও বাকি পাঁচ ব্যাংকের নিট মুনাফা মোট ১ হাজার ৪৫ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের বৈঠকে আইএমএফের মিশন সাধারণত যে যে বিষয় জানতে চায়, আমরা তা জানিয়েছি।’ এর বাইরে তিনি কিছু বলতে চাননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বিডিবিএল ছাড়া রাষ্ট্রমালিকানাধীন পাঁচ ব্যাংকের সংঘ স্মারক (এমওইউ) রয়েছে। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে রয়েছে বার্ষিক কর্ম কৃতি চুক্তি (এপিএ)। বৈঠক সূত্র জানায়, এ দুইয়ের আওতায় তাদের অর্জন নিয়ে বৈঠকে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে আইএমএফের মিশন।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ মিশনকে জানিয়েছে, খেলাপি ঋণ থেকে পাঁচ ব্যাংকের আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ১০ কোটি টাকা। তারা আদায় করেছে মাত্র ১ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা। আর অবলোপন করা ঋণ থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা, আদায় ৩৪৬ কোটি টাকা।
২০১৩-১৪ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিডিবিএল ছাড়া পাঁচ ব্যাংককে ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা পুনর্মূলধন দেওয়া হয়েছে বলেও জানানো হয়।
আরও জানানো হয়, পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং ঋণ আদায় পরিস্থিতি তদারকিতে জোর দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের ঘাটতির পাশাপাশি অন্য সমস্যা হচ্ছে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাগত। নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার জন্য ব্যাংকগুলোতে যথাযথ লোক নিয়োগ দেওয়া হয় না। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগই এ জন্য দায়ী। কারণ, নিয়োগের সুপারিশটি এ বিভাগই করেসালেহউদ্দিন আহমেদ সাবেক গভর্নর বাংলাদেশ ব্যাংক
বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংকগুলোকে আদালতের বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) পথে যেতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের (ডিএমডি) নেতৃত্বে প্রতিটি ব্যাংক যেন বিশেষ তদারক সেল গঠন করে। একই উদ্দেশ্যে পাবলিক অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি (পিএএমসি) গঠনের আইনি কাঠামো তৈরি নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আরও জানানো হয়েছে, এক ব্যাংক আরেক ব্যাংকের ঋণ কিনে নেওয়ার একটি চর্চা রয়েছে ব্যাংক খাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে এখন ঋণ কিনতে হবে বলে নতুন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বৈঠক সূত্র বলেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ আইএমএফের মিশনকে জানিয়েছে যে দেশে চাহিদার তুলনায় বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কম। দেশের অর্থনীতি এখন বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে ভুগছে। রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) দিয়ে সংকটের মোকাবিলা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে মার্কিন ডলারের অভাবে পণ্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা কমিয়ে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমদানি ব্যয় ছিল যেখানে ৮৩২ কোটি ডলার, এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে তা দাঁড়ায় ৫১৪ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছর আগের তুলনায় শুধু এক মাসে আমদানি ব্যয় কম হয়েছে ৩৮ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট পুরোপুরি না কাটার কারণ হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের জন্য আগে খোলা এলসির নিষ্পত্তি এখনো করতে হচ্ছে।
মিশনকে জানানো হয়েছে, সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের মানুষও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ভুগছে। কোভিড মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় ব্যাঘাত ঘটার কারণেই এমন পরিস্থিতি হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধির ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়েছে। ব্যাংকগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রার তারল্য ধীরে ধীরে বাড়ছে।
আইএমএফ চায় পাঁচটি আইনের সংশোধন। ঋণ কর্মসূচিতেও এ কথা রয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ মিশনকে জানায়, ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০২৩ গত ২৮ মার্চ অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা কমিটি। এটা এখন সংসদে পাঠানো হবে।
এক পরিবার থেকে ব্যাংকের পর্ষদে একাধিক ব্যক্তি যাতে থাকতে না পারেন এবং টানা ৯ বছর তাঁরা যাতে পর্ষদে থাকতে না পারেন, এটা আইএমএফের চাওয়া। বর্তমানে এক পরিবারের চারজন টানা ৯ বছর থাকতে পারেন ব্যাংকের পর্ষদে। আইনের খসড়ায় চারজন থেকে কমিয়ে তিনজন করা হলেও টানা বছরের ব্যাপারে হাত দেওয়া হয়নি। খসড়ায় ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের শাস্তির আওতায় আনাসহ তাদের বিভিন্ন সুবিধা কর্তনের কথা বলা হয়েছে।
গতকালের বৈঠকে আইএমএফের দল খসড়াটি দেখতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সংসদে পাঠানোর আগে তা দেখতে দেওয়া সম্ভব নয়।
আরও জানানো হয়, হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন, ১৮৮১–এর সংশোধনের খসড়া এখন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইনের খসড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষাসংক্রান্ত কমিটিতে আছে।
দেউলিয়া আইন, ১৯৯৭–এর সংশোধনের খসড়াটি পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩–কে নতুন করে করা হচ্ছে। ৫ এপ্রিল এর খসড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষার (ভেটিং) জন্য পাঠানো হয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন, সংসদ ও বিচারবিষয়ক বিভাগে। অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩–এর সংশোধনের খসড়াও আছে ভেটিংয়ের জন্য।
ব্যাংকগুলোকে সব সময় ভালো তারল্য সংরক্ষণ করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১৫ সাল থেকে তা সংরক্ষণ করেও আসছিল ব্যাংকগুলো। পুরো ব্যাংক খাতের তারল্য পরিস্থিতি ভালো থাকলেও ৯টি ব্যাংকের এ ব্যাপারে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। ৯ ব্যাংকের মধ্যে ৭টিই হচ্ছে ইসলামি ধারার শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক। আইএমএফ মিশনকে এ কথা জানানো হয়। তবে ৯ ব্যাংকের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
বলা হয়, ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো থেকে আমানত সরিয়ে গ্রাহকেরা তা নিয়ে গেছেন প্রচলিত ধারার ব্যাংকে। ইসলামি ধারার এ ব্যাংকগুলো এতে বড় ধরনের আমানত–সংকটে ভুগছে। কয়েক মাস ধরে এ ঘটনা ঘটছে। তবে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতের আমানতের চিত্র ইতিবাচক। মিশন এ ব্যাপারে বিশদ চিত্র জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ জন্য সময় চেয়েছে।
বৈঠকের চিত্র তুলে ধরলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ভালোই বলেছে আইএমএফকে। বলে তো আর লাভ নেই। মোদ্দা কথা হচ্ছে সমাধান করতে হবে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের ঘাটতির পাশাপাশি অন্য সমস্যা হচ্ছে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাগত। নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার জন্য ব্যাংকগুলোতে যথাযথ লোক নিয়োগ দেওয়া হয় না। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগই এ জন্য দায়ী। কারণ, নিয়োগের সুপারিশটি এ বিভাগই করে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘আইএমএফের পক্ষ থেকে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সংস্কারের কথা যেটুকু শুনছি, সব ভাসা–ভাসা মনে হচ্ছে। ব্যাংকের পরিচালকের কথাই যদি বলি, এক পরিবারের চারজনের টানা ৯ বছরের পরিবর্তে বড়জোর দুজনের শুধু ৩ বছর থাকা উচিত পর্ষদে। চারজনের পরিবর্তে তিন করা হচ্ছে আবার ৯ বছরের বিধানে হাতই দেওয়া হচ্ছে না। এটা কোনো সংস্কার হলো?’