প্রথম ধাপে খাতভেদে নগদ সহায়তা ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমবে। এতে পণ্য রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ডলার–সংকটের এ সময়ে পণ্য রপ্তানি বাড়ানো জরুরি, তবে রপ্তানি সেভাবে বাড়ছে না। এমন সময়ে পণ্য রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা বা ভর্তুকি দেওয়া থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রথম ধাপে খাতভেদে নগদ সহায়তা ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমবে। এতে পণ্য রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন রপ্তানিকারকেরা।
নগদ সহায়তার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হচ্ছে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাত। তবে এখন নগদ সহায়তা কাটছাঁট করা হলে তৈরি পোশাকশিল্পের কমপক্ষে অর্ধেক পণ্য রপ্তানিতে প্রণোদনা পাওয়া যাবে না। এ ছাড়া নগদ সহায়তা কমছে শীর্ষস্থানীয় রপ্তানি খাত চামড়া, পাটজাত পণ্য, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য, আসবাব, প্লাস্টিকসহ বেশকিছু পণ্যে।
রপ্তানিকারকেরা কিছুটা ধাক্কা খাবেন। তবে বর্তমানে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে রপ্তানি খাত সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। তাতে বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না।মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি
রপ্তানিকারকেরা বলছেন, করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তারপর হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতি টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে। তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা কমেছে। এই কঠিন সময়ে গত বছর রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার কমানো হয়েছে। প্রতিনিয়ত ব্যবসার খরচ বাড়ছে। গ্যাসের সংকট কাটছে না। অথচ ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ করে রাখা হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে হঠাৎ নগদ সহায়তা কাটছাঁট করার সিদ্ধান্তে বড় চাপের মধ্যে পড়বে দেশের রপ্তানি খাত।
তবে অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, রপ্তানিতে প্রণোদনা বা ভর্তুকি অনন্তকাল ধরে চলতে পারে না। সরকারের উচিত এখন ব্যবসার ক্ষেত্রে যেসব অদক্ষতা ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা আছে, সেগুলোর উন্নতি করা।
রপ্তানি খাতে নগদ সহায়তা কমানোর বিষয়টি গতকাল মঙ্গলবার এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বলা হয়েছে, ১ জানুয়ারি থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য গত আগস্টে রপ্তানি প্রণোদনার প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও মাঝপথে তা স্থগিত করা হলো।
নগদ সহায়তা কমানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হবে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধিবিধান অনুসারে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ হলে কোনো ধরনের রপ্তানি প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা দেওয়া যায় না। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর একবারে নগদ সহায়তা প্রত্যাহার করা হলে রপ্তানি খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। সে জন্য চলতি বছর থেকে অল্প অল্প করে নগদ সহায়তা কমানোর বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনের বিষয়ে গতকাল রাতে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ এবং বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর চার নেতার সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তাঁরা প্রত্যেকেই বলেন, নগদ সহায়তা কমানোর বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা কিংবা বৈঠক হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগদ সহায়তা কমানো-বাড়ানোর বিষয়ে অতীতে যেভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো, এবার কিছুটা ব্যতিক্রমভাবে করা হয়েছে। হঠাৎ গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠি বাংলাদেশ ব্যাংকে যায়। তারপর বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ তড়িঘড়ি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। এই রপ্তানি তার আগের অর্থবছরের তুলনায় ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি ছিল। তবে চলতি অর্থবছরে প্রথমার্ধে প্রবৃদ্ধির গতি কমেছে। অর্থবছরে প্রথম ছয় মাসে ২ হাজার ৭৫৪ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে দশমিক ৮৪ শতাংশ।
সরকার গত অর্থবছরে রপ্তানির প্রণোদনা জন্য ৯ হাজার ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিল। তবে প্রণোদনার প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা এখনো সরকার পরিশোধ করতে পারেনি বলে জানালেন একাধিক ব্যবসায়ী।
পোশাক খাতে প্রভাব বেশি
দেশের সামগ্রিক পণ্য রপ্তানির মধ্যে ৮৪ শতাংশই তৈরি পোশাক খাতের দখলে। ফলে এই খাতের উদ্যোক্তারা নগদ সহায়তার বড় অংশ পান। তবে সরকারের নতুন সিদ্ধান্তে প্রায় ৫৬ শতাংশ পোশাক রপ্তানিতে নগদ সহায়তা পাওয়া যাবে না বলে জানান বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতারা। তাঁরা বলছেন, রপ্তানির ক্রয়াদেশ নেওয়ার সময় ভর্তুকিসহ হিসাব করে পণ্যের দর নির্ধারণ করা হয়। ফলে পূর্ব ঘোষণা ছাড়া সরকার মাঝপথে এসে এভাবে হঠাৎ ভর্তুকি তুলে নেওয়া ও কমানোর কারণে তাঁদের বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, রপ্তানিমুখী দেশীয় বস্ত্র খাতে শুল্ক বন্ড ও ডিউটি ড্র-ব্যাকের পরিবর্তে বিকল্প নগদ সহায়তা ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। ইউরো অঞ্চলে বস্ত্র খাতের রপ্তানিকারকদের অতিরিক্ত বিশেষ সহায়তা ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ১ শতাংশ। পোশাক খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানার রপ্তানি প্রণোদনা ৪ শতাংশ বহাল রয়েছে। তবে নতুন পণ্য বা নতুন বাজারে ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ৩ শতাংশ। নতুন বাজার থেকে ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশেষ নগদ সহায়তা ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে।
একই সঙ্গে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, পাঁচটি এইচএস কোডের পোশাক রপ্তানিতে নগদ সহায়তা পাওয়া যাবে না। পণ্যগুলো হচ্ছে নিট কাপড়ের টি–শার্ট, শার্ট, ট্রাউজার, ওভেন কাপড়ের জ্যাকেট, ব্লেজার ইত্যাদি। আর দীর্ঘদিন ধরে এগুলোই হচ্ছে দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের শীর্ষ রপ্তানি পণ্য।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে পাঁচটি এইচএস কোডের পোশাক নগদ সহায়তা পাবে না বলা হয়েছে, সেগুলো থেকেই গত অর্থবছরে আমাদের ৫৬ শতাংশ রপ্তানি হয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। শ্রমিকের মজুরিও বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ নগদ সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্ত আমাদের রপ্তানিকারকদের বড় রকমের অসুবিধায় ফেলবে।’
অন্যদিকে বিকেএমইএর সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচটি এইচএস কোডের মধ্যে চারটিই নিট খাতে। ফলে নিট পোশাকের ৭০-৮০ শতাংশই নগদ সহায়তার বাইরে চলে যাবে। বর্তমান দেশে-বিদেশে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে রপ্তানি খাত। এমন প্রেক্ষাপটে প্রণোদনা এই খাতকে টিকে থাকতে সহায়তা করত পারত। নগদ সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্তে ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো সম্ভাবনাময় বাজারে রপ্তানি সম্প্রসারণও বাধাগ্রস্ত হবে।
অন্য খাতে প্রণোদনা কত কমল
তৈরি পোশাকের পর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বর্তমানে দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি খাত। বিদায়ী অর্থবছরে ১২৫ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি তার আগের অর্থবছরের তুলনায় পৌনে ২ শতাংশ কম। চলতি অর্থবছর এই খাতের রপ্তানি কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ। রপ্তানিতে ধুঁকতে থাকা চামড়া খাতের প্রণোদণাও কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ক্রাস্ট লেদার রপ্তানিতে প্রণোদনা পুরোপুরি তুলে দেওয়া হয়েছে। আর ফিনিশড লেদারে ভর্তুকি ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে আগে ১৫ শতাংশ প্রণোদনা থাকলেও এখন থেকে তা কমে ১২ শতাংশ হবে।
পণ্য রপ্তানিতে নতুন সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে এই খাত থেকে ১১৬ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় এসেছে। যদিও গত অর্থবছর কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের রপ্তানি ২৭ শতাংশ কমেছে। চলতি অর্থবছর আবার ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে খাতটির রপ্তানি। নতুন নিয়মে কৃষিপণ্য ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যে ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
একই ভাবে দেশের রপ্তানি খাতের মধ্যে একটি পাট ও পাটজাত পণ্য। যদিও গত কয়েক বছর এই খাতের রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে কমছে। তারপরও বৈচিত্র্যময় পাটপণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫, পাটজাত পণ্যে ১২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশ এবং পাট সুতায় প্রণোদনা ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে।
একইভাবে হালকা প্রকৌশল পণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা ১৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ, ওষুধের কাঁচামালে ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ এবং শতভাগ হালাল মাংসে প্রণোদনা ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
এ ছাড়া হিমায়িত চিংড়ি, মোটরসাইকেল, রেজার ও রেজার ব্লেড, কনজু৵মার ইলেকট্রনিক, পেট বোতল ফ্লেক্স, জাহাজ, প্লাস্টিক দ্রব্য, হাতে তৈরি পণ্য যেমন হোগলা, খড়, আখ বা নারিকেলের ছোবড়া, গার্মেন্টের ঝুট, গরু–মহিষের নাড়ি–ভুঁড়ি, শিং ও রগ; কাঁকড়া ও কুঁচে, পাটকাঠি থেকে উৎপাদিত কার্বন ও জুট পার্টিকেল বোর্ড, শস্য ও শাকসবজির বীজ, আগর, আতর ইত্যাদি রপ্তানিতে নগদ সহায়তা কমেছে।
তবে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি হিসেবে সরকার ধাপে ধাপে নগদ প্রণোদনা কমানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটি ঠিকই আছে। এতে রপ্তানিকারকেরা কিছুটা ধাক্কা খাবেন। তবে বর্তমানে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে রপ্তানি খাত সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। তাতে বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। তারপরও রপ্তানিকারকদের আর্থিক যে সুবিধা এতে কমবে, সেটি ব্যবসার পরিবেশের উন্নয়ন ও ব্যবসার খরচ কমানোর মাধ্যমে যাতে পুষিয়ে নেওয়া যায়, সে জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।