দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এখন দিনে ২৫০ কোটি ঘনফুটের নিচে নেমে এসেছে গ্যাসের সরবরাহ।
দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এখন দিনে ২৫০ কোটি ঘনফুটের নিচে নেমে এসেছে গ্যাসের সরবরাহ।

শিল্পে তীব্র গ্যাস–সংকট, দুশ্চিন্তায় উদ্যোক্তারা

  • দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। মোটামুটি ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ পেলেও বড় ধরনের সংকট হয় না।

  • এখন দিনে ২৫০ কোটি ঘনফুটের নিচে নেমে এসেছে গ্যাসের সরবরাহ।

বেলা সাড়ে ১১টা। এম এস ডাইং, প্রিন্টিং অ্যান্ড ফিনিশিং কারখানার ডাইং ইউনিটের অধিকাংশ বৈদ্যুতিক বাতিই বন্ধ। ফলে তৈরি হয়েছে কিছুটা আলো-আঁধারি পরিবেশ। দৈত্যকার যন্ত্রগুলোও চুপচাপ। শ্রমিকেরা আসেন, তবে কাজ নেই। অলস সময় কাটান তাঁরা। অথচ দিনের এই সময়ে টনে টনে নিট কাপড় রং করতে যন্ত্রগুলোর সঙ্গে শ্রমিকেরা সাধারণত মহাব্যস্ত সময় পার করেন।

গ্যাস-সংকটের কারণে ৯ দিন ধরে এই কারখানায় পুরোপুরি নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে বলে জানালেন প্রতিষ্ঠানটির উপমহাব্যবস্থাপক কবীর আহমেদ। তিনি জানান, দিনে ১১০ টন কাপড় ডাইংয়ের সক্ষমতা থাকলেও গত তিন মাস গ্যাস-সংকটের কারণে ৮০ থেকে ৮৫ টনের মতো কাপড় রং করা গেছে। কিন্তু ৮ জানুয়ারি থেকে গ্যাসের চাপ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। ফলে টানা ৯ দিন ধরে কাপড় ডাইং বন্ধ রয়েছে।

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় অবস্থিত বিসিক শিল্পনগরীর এম এস ডাইং, প্রিন্টিং অ্যান্ড ফিনিশিং কারখানার মতো এই জেলার প্রায় সাড়ে চার শ শিল্পকারখানা বছরের শুরু থেকে তীব্র গ্যাস-সংকটে ভুগছে। নারায়ণগঞ্জের পাশাপাশি আরও দুই শিল্প এলাকা সাভার ও গাজীপুরের শ্রীপুরেও একই পরিস্থিতি। গ্যাসের তীব্র সংকটের কারণে এসব এলাকার ডাইং কারখানা, সুতার কল বা স্পিনিং মিল, খাদ্যপণ্য, কাগজকলসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সেই তুলনায় কিছুটা ভালো অবস্থানে আছে হবিগঞ্জ, নরসিংদী, ময়মনসিংহের ভালুকা ও চট্টগ্রামের শিল্পকারখানাগুলো। চাহিদার তুলনায় কম গ্যাস পেলেও উৎপাদন মোটামুটি চালিয়ে নিতে পারছে তারা।

গ্যাস সমস্যা নিয়ে পেট্রোবাংলা কিংবা তিতাসের উচ্চপর্যায়ের কেউ কোনো কথা বলে না। এখন কাউকে ফোন দিলেও পাওয়া যায় না। বলতে বলতে আমরা ক্লান্ত।
মোহাম্মদ আলী, সভাপতি, বিটিএমএ

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, বন্দর, রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজার উপজেলার অন্তত ১০ জন শিল্পোদ্যোক্তার সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তাঁরা জানালেন, দীর্ঘদিন ধরে গ্যাসের সংকট থাকলেও গত তিন মাস রাতে ৬-৭ ঘণ্টা এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিনে গ্যাসের যে চাপ থাকত, তাতে উৎপাদন মোটামুটি চলত। তবে জানুয়ারির শুরু থেকে দিনে বা রাতে কোনো সময়ই কারখানার উৎপাদন চালানোর মতো গ্যাস মিলছে না বললেই চলে। এতে উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। কোনো কোনো কারখানা বিকল্প ব্যবস্থায় বাড়তি ব্যয় করে উৎপাদন সচল রাখার চেষ্টা করছে। গ্যাসের এই সংকট শিগগিরই সমাধান না হলে শ্রমিক ছাঁটাই এবং কারখানা বন্ধের মতো ঘটনা বাড়বে বলে জানালেন উদ্যোক্তারা।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র বলছে, দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। মোটামুটি ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ পেলেও বড় ধরনের সংকট হয় না। কিন্তু এ পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ পাওয়া যায় না। দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমছে। এলএনজি আনা হচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় কম। তাই এখন দিনে ২৫০ কোটি ঘনফুটের নিচে নেমে এসেছে গ্যাসের সরবরাহ। দেখা গেছে, সরবরাহ কমলে নারায়ণগঞ্জসহ কয়েকটি এলাকার শিল্পকারখানা বেশি সংকটে পড়ে।

জানতে চাইলে বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে গ্যাস-সংকট চরম অবস্থায় চলে গেছে। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজার; গাজীপুরের শ্রীপুর ও সাভার এলাকায় সংকট বেশি। এসব এলাকার ডাইং কারখানাগুলো বেশি ভুগছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গ্যাস সমস্যা নিয়ে পেট্রোবাংলা কিংবা তিতাসের উচ্চপর্যায়ের কেউ কোনো কথা বলে না। এখন কাউকে ফোন দিলেও পাওয়া যায় না। বলতে বলতে আমরা ক্লান্ত।’

সরেজমিন নারায়ণগঞ্জ

নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লার বিসিক শিল্পনগরে ফেয়ার অ্যাপারেলস নামের পোশাক কারখানার ভবনের নিচে ১৪টি বড় এলপিজি সিলিন্ডার বসানো হয়েছে। পাইপলাইনের গ্যাস সরবরাহে দীর্ঘদিন ধরে সংকট চলতে থাকায় কারখানার আয়রন চালাতে এমন ব্যবস্থা করে নিয়েছে মালিকপক্ষ। যদিও গ্যাস-সংকটের কারণে তাদের ডাইং ইউনিটের উৎপাদন ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে।

ফেয়ার অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ডাইং ইউনিটে দিনে ৩০ টন কাপড় ডাইং করার সক্ষমতা আছে। কিন্তু গ্যাস-সংকটের কারণে ১৩, ১৪ ও ১৫ জানুয়ারি ডাইং করতে পেরেছি যথাক্রমে ৭, ৬ ও ৭ টন। রাতে অল্প গ্যাস ও ডেসার বিদ্যুৎ ব্যবহারে এটুকু উৎপাদন করা যাচ্ছে। অথচ বর্তমানে আমাদের পোশাক কারখানায় প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫ টন কাপড় দরকার।’

মোহাম্মদ কাশেম আরও জানান, এই গ্যাস-সংকটের নেতিবাচক প্রভাব ইতিমধ্যে কর্মসংস্থানের ওপর পড়তে শুরু করেছে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস-সংকট চলছে। কখনো কম, কখনো বেশি। ফলে সক্ষমতা অনুযায়ী তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ নেওয়া যাচ্ছে না। আর কাজ না থাকায় গত ছয় মাসে অন্তত ৫০০ কর্মীকে বাদ দিতে হয়েছে।

এই শিল্পনগরের অন্যতম শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক ফকির অ্যাপারেলস। তারা প্রতি মাসে ১ কোটি ২০ লাখ থেকে ১ কোটি ৩০ লাখ ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। কারখানাটিতে কাজ করেন ১২ হাজার কর্মী।

গ্যাস-সংকটের কারণে ফকির অ্যাপারেলের ডাইং ইউনিটের উৎপাদন কমে গেছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা বখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ডাইং ইউনিটে দিনে ৪০ টন কাপড় রং করা হয়। গ্যাস না পাওয়ায় আমরা এলপিজি ও ডিজেল দিয়ে ২৮ টন পর্যন্ত কাপড় রং করতে পারছি। এই বিকল্প জ্বালানির পেছনে আমাদের প্রতিদিন ১৫ লাখ টাকা বাড়তি ব্যয় হচ্ছে। অন্যদিকে ক্রেতাদের সময়মতো পণ্য দিতে আমাদের ওভারটাইমও বেশি করতে হচ্ছে।’

রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতায় লিটল স্টার স্পিনিং মিলের সুতা উৎপাদন গ্যাস-সংকটের কারণে উৎপাদন সক্ষমতার ৫৫ শতাংশ অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। মিলটিতে প্রতি মাসে ১ লাখ ২০ হাজার পাউন্ড সুতা উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে।

তিন সপ্তাহ ধরে গ্যাসের চাপ খুবই কম। উৎপাদন কমে যাওয়ায় প্রতি পাউন্ড সুতায় আমাদের ২৭ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।
মোহাম্মদ খোরশেদ আলম, চেয়ারম্যান, লিটল স্টার স্পিনিং মিল, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ

জানতে চাইলে লিটল স্টার স্পিনিং মিলের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন সপ্তাহ ধরে গ্যাসের চাপ খুবই কম। উৎপাদন কমে যাওয়ায় প্রতি পাউন্ড সুতায় আমাদের ২৭ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।’

এদিকে বন্দর উপজেলার কারখানাগুলো এক মাস ধরে তীব্র গ্যাস-সংকটের মধ্যে আছে বলে উদ্যোক্তারা জানালেন। প্রথম আলোকে সেখানকার দুজন উদ্যোক্তা বললেন, ১৬ ডিসেম্বরের পর তাঁরা উৎপাদন চালানোর মতো গ্যাসের চাপ পাননি।

টোটাল ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হাসিব উদ্দিন মিয়া বলেন, ‘দুই হাজার শ্রমিক নিয়ে দুর্ভোগের মধ্যে আছি। মাসে আমরা ২৫ থেকে ৩০ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করি। গ্যাস-সংকটের কারণে ডাইং ইউনিট এক মাস ধরে বন্ধ থাকায় পোশাক রপ্তানি ৬ লাখ ডলারে নেমেছে। নরসিংদী থেকে সামান্য কিছু কাপড় ডাইং করে আনতে পারছি। সময়মতো পণ্য শিপমেন্ট করতে না পারায় ৪ লাখ ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে।’ অনেকটা হতাশ কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, এভাবে আরও কিছুদিন চললে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।

এই উপজেলায় বাশার পেপার মিল নামে একটি কাগজের কারখানা রয়েছে। গ্যাস-সংকটের কারণে তাদের কাগজ উৎপাদন ৮০ শতাংশ কমে গেছে। এই কারখানায় কাজ করেন ৪০ জন কর্মী।

জানতে চাইলে বাশার পেপার মিলের ব্যবস্থাপক মোস্তফা কামাল গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, রাতের বেলায় ৩-৪ ঘণ্টার জন্য গ্যাসের চাপ ১ থেকে ২ পিএসআইয়ের মধ্যে থাকে। তখন গ্যাসের পাশাপাশি ডিজেল জেনারেটর ব্যবহার করে আমরা ৫-৭ টন কাগজ উৎপাদন করতে পারছি। তবে ডিজেল ব্যবহারের কারণে উৎপাদন ব্যয় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বর্তমানে যে অবস্থা, তাতে কারখানা না পারছি চালাতে, না পারছি বন্ধ রাখতে। দিনের পর দিন লোকসান করে কত দিন টিকতে পারব, জানি না।’

নারায়ণগঞ্জে গ্যাসের পরিস্থিতি এত খারাপ কেন তা নিয়ে গতকাল বিকেলে তিতাস গ্যাসের কার্যালয়ে সংস্থাটির উপমহাব্যবস্থাপক মামনুর রশীদের সঙ্গে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নারায়ণগঞ্জে গ্যাসের লাইন পুরোনো হওয়ায় সক্ষমতা কম। সেই তুলনায় গ্রাহকের সংখ্যা বেশি। এ কারণে নারায়ণগঞ্জে সব সময় গ্যাসের কমবেশি সংকট থাকে। বর্তমানে জাতীয়ভাবে গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি বেশি খারাপ হয়েছে। সংকট কবে কাটবে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, তাঁর জানা নেই।

শিল্পকারখানা টিকিয়ে রাখতে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে সরকারকে অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে মন্তব্য করলেন নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সরকার কি শিল্পকে গ্যাস দেবে না কি সার কারখানাকে গ্যাস দেবে, তা নির্ধারণ করতে হবে। কিছু কিছু সার দেশে উৎপাদন করার চেয়ে আমদানি করলে কম ব্যয় হয়। সেসব সার উৎপাদন বন্ধ রেখে শিল্পে গ্যাস দেওয়া প্রয়োজন। গ্যাসের এমন সংকট চলতে থাকলে কারখানা বন্ধ হবে। শ্রমিকেরা কাজ হারাবেন।