দেশে পেঁয়াজের ভান্ডারখ্যাত পাবনার সুজানগর ও সাঁথিয়া উপজেলায় মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে পাইকারিতে মণপ্রতি দাম ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা কমেছে। এর আগে অবশ্য হঠাৎ করেই তিন–চার দিনে পেঁয়াজের দাম মণে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা বেড়েছে। পেঁয়াজের দামে এ রকম ওঠানামাকে ‘অস্বাভাবিক’ বলছেন স্থানীয় ব্যাপারী ও কৃষকেরা। তাঁদের মতে, ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানির প্রভাবসহ আরও কিছু কারণে এমন হয়েছে।
কৃষক, ব্যবসায়ী ও কৃষি কর্মকর্তারা জানান, সুজানগর ও সাঁথিয়া উপজেলায় দেশি পেঁয়াজের মজুত এখন শেষের পথে। দুই উপজেলায় গত মঙ্গলবার পর্যন্ত কৃষকের ঘরে পেঁয়াজের মজুত ছিল ৫৫ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে সুজানগরে ২৫ হাজার ও সাঁথিয়ায় ৩০ হাজার টন মজুত ছিল। মজুতের বড় অংশই মুড়িকাটা বা আগাম জাতের পেঁয়াজ আবাদের বীজ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। চলতি বছর এ দুই উপজেলায় মোট পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ১৪ হাজার ৫৫০ টন।
আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশি পেঁয়াজের মজুত ও সরবরাহ কমায় বাজার অনেকটাই আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ছে। ভারত অথবা অন্য দেশ থেকে আমদানি বন্ধ থাকলে বা কমলেই দেশে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়। আবার আমদানি বাড়লে দাম কমে।
সাঁথিয়ার করমজা চতুরহাটের ইছামতী নামক আড়তের ব্যবস্থাপক কোরবান আলী প্রথম আলোকে জানান, তিন দিন বন্ধ থাকার পর গত সোমবার দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে প্রচুর পেঁয়াজ দেশে ঢুকেছে। সেই পেঁয়াজ পরদিন মঙ্গলবার ব্যাপারীরা তাঁদের আড়তে নিয়ে আসেন, যা পাইকারিতে প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১০২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ তিন-চার দিন আগেও পেঁয়াজ ১০৮ থেকে ১১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।
করমজা চতুরহাটের আব্দুল মুন্নাফ ও বোয়ালমারী হাটের রাজা হোসেন দুজনেই আড়তদার। আলাদা আলাপে তাঁরা জানান, খাওয়ার উপযোগী দেশি পেঁয়াজ এখন একেবারেই কমে গেছে। ফলে আমদানি করা পেঁয়াজের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে গেছে। যে কারণে কদিন আগে দেশি পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। গত রোববার প্রতি মণ দেশি পেঁয়াজের দাম ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা বেড়ে ৬ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত ওঠে। এরই মধ্যে ভারতীয় পেঁয়াজের আমদানি বৃদ্ধি পায়। ফলে মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার তিন দিনে পেঁয়াজের মণপ্রতি দাম ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা কমেছে। মঙ্গলবার থেকে দেশি পেঁয়াজ প্রতি মণ ৫ হাজার ২০০ থেকে ৫ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে হলে নতুন পেঁয়াজ না ওঠা পর্যন্ত ভারত থেকে আমদানি অব্যাহত রাখতে হবে।
স্থানীয় কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এবার সুজানগরে ১৯ হাজার ৩৬০ ও সাঁথিয়ায় ১৬ হাজার ৬২৭ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সুজানগরে ১ হাজার ৫৬০ ও সাঁথিয়ায় ১ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে আগাম বা মুড়িকাটা জাতের পেঁয়াজ আবাদের সম্ভাবনা রয়েছে। আগের বছরগুলোতে অক্টোবরের মধ্যেই আগাম পেঁয়াজের আবাদ প্রায় শেষ হয়ে যেত। কিন্তু এবার বৈরি আবহাওয়ার কারণে মুড়িকাটা পেঁয়াজের আবাদ কম হয়েছে বা বিলম্বিত হচ্ছে। যা–ই হোক, উঁচু জায়গা হওয়ায় সুজানগরে ইতিমধ্যে ১ হাজার ১২০ হেক্টরে, আর নিচু এলাকা সাঁথিয়ায় মাত্র ৩০ হেক্টরে আগাম বা মুড়িকাটা পেঁয়াজের চাষ হয়েছে। আবাদে দেরি হওয়ায় এবার মুড়িকাটা পেঁয়াজ কিছুটা দেরিতে বাজারে আসবে।
এদিকে সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, দুই উপজেলায় এখনো যে পেঁয়াজ রয়েছে, তার বেশির ভাগই বড় ও অবস্থাপন্ন কৃষকদের কাছে। কৃষকেরা মজুত পেঁয়াজের কিছু অংশ আগাম জাতের পেঁয়াজের বীজ হিসেবে ব্যবহার করছেন, বাকি অংশ যাচ্ছে বাজারে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের উদ্যোগে সাঁথিয়ার অবস্থাপন্ন কৃষক সাইদুল ইসলামের বাড়িতে তৈরি করা হয়েছে ‘পেঁয়াজ সংরক্ষণের মডেল ঘর’, যাতে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে পারেন। সাইদুল ইসলাম জানান, মডেল ঘরে তিনি নিজের ২০০ মণ পেঁয়াজ সংরক্ষণ করেছিলেন। সেই পেঁয়াজ থেকে ১৫-২০ দিন আগে প্রায় দেড় শ মণ বিক্রি করেছেন। অবশিষ্ট পেঁয়াজ আগাম বা মুড়িকাটা জাতের পেঁয়াজের বীজ হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
সাঁথিয়ার করমজা চতুরহাটে শহীদনগর গ্রামের কৃষক আফতাবউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেড় বিঘা জমিতে পেঁয়াজের আবাদ কইর্যা ৭০ মণের মতো পেঁয়াজ পাইছিল্যাম। ৬০ মণ আগেই বেচছি। বেশি দরের কথা শুইন্যা হাটে পাঁচ মণ পেঁয়াজ আইন্যা দেখি দুই দিনে মণে ৭০০–৮০০ টাকা দাম কুমিছে। তবে সব মিলায়া এবার পেঁয়াজ বেইচ্যা ভালো লাভ পাইছি।’
সুজানগর ও সাঁথিয়া উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা যথাক্রমে রাফিউল ইসলাম ও সঞ্জীব কুমার গোস্বামী পৃথক আলাপে জানান, এখন যে পেঁয়াজ মজুত রয়েছে, তা আছে বড় ও অবস্থাপন্ন কৃষকের ঘরে। কারণ, প্রান্তিক কৃষকেরা টাকার প্রয়োজনে আগেই পেঁয়াজ বিক্রি করে দিয়েছেন। এবার পেঁয়াজের দাম বেশি হওয়ায় কৃষক লাভবান হয়েছেন। এটা ভালো দিক। কারণ, আগের বছরগুলোতে তাঁরা লোকসান দিয়েছেন। পেঁয়াজের দাম ভালো পাওয়ায় ভবিষ্যতে কৃষকেরা আরও বেশি জমিতে পেঁয়াজ আবাদে উৎসাহী হবেন।