আগের সব রেকর্ড ভেঙে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অন্তত ১৯৯ জন ব্যবসায়ী সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের।
জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। স্বাধীনতার পর সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিটি সংসদে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়েছে। বিদায়ী সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল ১৮২। তবে সব রেকর্ড ভেঙেছে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন। আগামী ১২তম জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়ে হবে অন্তত ১৯৯ জন, যা মোট সংসদ সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশ। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশাসনের জন্য যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা মনে করেন জাতীয় সংসদে ও রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের এই ক্রমবর্ধমান আধিপত্য রাজনীতিতে রাজনীতিবিদদেরই কোণঠাসা করে ফেলছে। তাঁদের মতে, সংসদের মৌলিক চরিত্রই এর ফলে পরিবর্তিত হচ্ছে এবং ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ‘নীতিকাঠামো দখল’ করছেন নিজেদের ‘অর্থসম্পদ ও ব্যবসা বিকাশের’ স্বার্থে। ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে যে বিনিয়োগ করছেন, তা করছেন মূলত নিজেদের সম্পদ আরও বাড়ানোর জন্য।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো রওনক জাহান রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ ও এর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা যে বিপুল সংখ্যায় সংসদে যাচ্ছেন, তাতে ইতিবাচক কিছু দেখছি না। একটি সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যদি ব্যবসায়ীরা সংসদে যেতেন, তাহলে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু কিছু ব্যবসায়ী অসম সুবিধা নিয়ে সরকারের কাছাকাছি গিয়ে নিজেদের স্বার্থ পূরণ করছেন। জনপ্রতিনিধি হয়ে এসব ব্যবসায়ী ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীগত সুবিধার লক্ষ্যে টাকাপয়সা বানাচ্ছেন। তাঁরা অন্যায় বিশেষাধিকার নিচ্ছেন এবং এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই।’
রওনক জাহান বলেন, ‘রাজনীতি ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে যোগসূত্র গড়ে উঠেছে, সেটার সুবিধা নিচ্ছেন কিছু ব্যবসায়ী। রাজনীতি বা সংসদে ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী হওয়ার কারণে তাঁরা নিজেদের সুবিধার জন্য নীতি তৈরি করছেন। ফলে এখন যাঁরা ব্যবসা-বাণিজ্যে সিন্ডিকেট করছেন, কিংবা ব্যাংকে অনিয়ম করছেন বা ব্যাংক দখল করছেন, তাঁদের ধরা যাচ্ছে না। তাঁরা রাজনীতিতে প্রভাবশালী হওয়ার কারণে তাঁদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো সংস্কার করা যাচ্ছে না।’
ব্যবসায়ীরা যে বিপুল সংখ্যায় সংসদে যাচ্ছেন, তাতে ইতিবাচক কিছু দেখছি না। একটি সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যদি ব্যবসায়ীরা সংসদে যেতেন, তাহলে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু কিছু ব্যবসায়ী অসম সুবিধা নিয়ে সরকারের কাছাকাছি গিয়ে নিজেদের স্বার্থ পূরণ করছেন।রওনক জাহান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আরও একবার আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। বিএনপি ও আরও কিছু দলের বর্জনের মধ্যে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে জয়ী ২৮০ জনই আওয়ামী লীগের মনোনীত কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন, যাঁরা সত্যিকার অর্থে দলটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এর বাইরে নির্বাচনে বিজয়ী ১৩ জন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক ও মিত্র দলের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। মাত্র পাঁচজন ভিন্ন দল বা মতের।
মনোনয়নপত্রের সঙ্গে প্রার্থীরা যে হলফনামা দিয়েছেন, তা বিশ্লেষণ করে নাগরিক অধিকার সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) জানায়, নির্বাচনে ১ হাজার ৯৪৫ জন প্রার্থীর মধ্যে ১ হাজার ১৪২ জনই ছিলেন ব্যবসায়ী (৫৮ দশমিক ৭১ শতাংশ)। আওয়ামী লীগের ২৬৫ জনের মধ্যে ১৭০ জন, জাতীয় পার্টির ২৬২ জনের মধ্যে ১৭৩ জন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ৪৩৩ জনের মধ্যে ৩০২ জনই ব্যবসায়ী।
সুজনের তথ্য ও নির্বাচন কমিশনের প্রকাশ করা বিজয়ীদের বেসরকারি তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ২৯৮ আসনে বিজয়ীদের মধ্যে ব্যবসায়ী ১৯৪ জন। তার মধ্যে আওয়ামী লীগের ১৪৫ জন, জাতীয় পার্টির ৯ জন, জাসদের ১ জন, কল্যাণ পার্টির ১ জন এবং স্বতন্ত্র ৩৮ জন রয়েছেন। সুজনের তালিকার বাইরে আরও অন্তত ৫ জন ব্যবসায়ী নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন বলে প্রথম আলোর বিশ্লেষণে দেখা গেছে। তাঁদের মধ্যে ৪ জন আওয়ামী লীগের ও ১ জন স্বতন্ত্র। সব মিলিয়ে অন্তত ১৯৯ জন ব্যবসায়ী এবার জাতীয় সংসদে সদস্য হিসেবে বসতে যাচ্ছেন। এর বাইরে নির্বাচিত যে ৪০ জন নিজেদের রাজনীতিবিদ ও কৃষিজীবী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকের মূল পেশা ব্যবসা।
স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকে জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বেড়েছে ৪৮ শতাংশীয় পয়েন্ট। আইনপ্রণেতা হিসেবে ব্যবসায়ীদের এই উত্থানের ফলে সংসদে অন্য পেশা থেকে আসা জনপ্রতিনিধির সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমেছে। আবার কিছু রাজনীতিবিদ রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসাও করছেন।
আইনপ্রণেতা হিসেবে ও দেশের রাজনীতিতে আইনজীবীদের একসময় দাপট ছিল। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে বড় সংখ্যায় তাঁদের ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে। তবে গত ৩০ বছর সময়ে বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনজীবীদের অংশগ্রহণ কমেছে, বেড়েছে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ।
দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) তথ্যানুযায়ী, ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ী ছিলেন ১৮ শতাংশ আর আইনজীবী ৩১ শতাংশ। যদিও রওনক জাহান তাঁর বাংলাদেশ পলিটিকস: প্রবলেমস অ্যান্ড ইস্যুজ বইয়ে লিখেছেন, প্রথম জাতীয় সংসদে ২৮৩ আসনের মধ্যে সাড়ে ২৫ শতাংশ আইনজীবী, ২৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী, ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ কৃষক, শিক্ষক ৯ দশমিক ৮৯ এবং ১২ দশমিক ৩৬ শতাংশ রাজনীতিবিদ ছিলেন।
সরকারের মন্ত্রিসভার অন্তত একজন সদস্যের নিজ নামে বিদেশে একাধিক কোম্পানি থাকার প্রমাণ রয়েছে বলে জানিয়েছিল টিআইবি। এই মন্ত্রী ও তাঁর স্ত্রীর মালিকানাধীন ছয়টি কোম্পানি এখনো বিদেশে সক্রিয়ভাবে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা পরিচালনা করছে, যার মূল্য ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। এই মন্ত্রী তাঁর হলফনামায় বিদেশে থাকা সম্পদের ব্যাপারে তথ্য দেননি।
সুজন ও টিআইবির তথ্য বলছে, ১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদে ব্যবসায়ীদের হার বেড়ে ৩৮ শতাংশ হয়। আর ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী ৩০০ জন সদস্যের মধ্যে ৬২ শতাংশই ছিলেন ব্যবসায়ী। বাকিদের মধ্যে আইনজীবী ১৪ শতাংশ, কৃষিজীবী ৪ শতাংশ এবং রাজনীতিবিদ ছিলেন ৭ শতাংশ।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বেড়েছে, এটা বলা যাবে না। তাঁদের রাজনৈতিক শক্তিমত্তা আসে ব্যবসায়ী হিসেবে অর্থের মালিক হওয়ার কারণে। এটা সর্বজনবিদিত যে বাংলাদেশে নমিনেশন বাণিজ্য হয় এবং অনেককে নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হয় অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে। অনেক রাজনীতিবিদ বলেছেন, রাজনীতিতে তাঁরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন এবং তাঁরা বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিতে পরিণত হয়েছেন।
সংসদে নিজেদের স্বার্থে আইন প্রণয়নের উদাহরণ দিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বড় সমস্যা হলো রাষ্ট্রের নীতিকাঠামো দখল হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকিং, পোশাকশিল্প বা বিদ্যুতের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যবসায়ীরা ঠিক করছেন নীতিকাঠামো কী হবে। সংসদের মৌলিক চরিত্র বদলে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। আইন প্রণয়ন, সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার পরিবর্তে তাঁরা নেতৃত্বের প্রশংসা ও নিজেদের সুযোগ-সুবিধার দিকে বেশি নজর দিচ্ছেন।
গত জাতীয় সংসদে ব্যাংকিং কোম্পানি আইনে এমন পরিবর্তন আনা হয়েছিল, যা এমনকি মন্ত্রিসভার বৈঠকেও প্রস্তাব করা হয়নি। সংশোধিত আইনে ব্যাংক মালিকদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, শুধু সংসদে নয়, রাষ্ট্রকাঠামোতেও ব্যবসায়ীদের প্রভাব বিকশিত হচ্ছে। ঋণ খেলাপির মতো বিষয়ে নীতি ব্যবসায়ীরাই ঠিক করে দিচ্ছেন। বাংলাদেশে রাজনীতি ও ব্যবসা একাকার হয়ে গেছে, মূলত অর্থসম্পদ বিকাশের জন্য ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে আসছেন। ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে বিনিয়োগ করছেন, তাঁদের জন্য মূল বিষয় মুনাফা অর্জন।
সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বেড়েছে, এটা বলা যাবে না। তাঁদের রাজনৈতিক শক্তিমত্তা আসে ব্যবসায়ী হিসেবে অর্থের মালিক হওয়ার কারণে।ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতিদের অনেকেই সংসদ সদস্য হয়েছেন বা রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন চেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ঢাকা-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছেন শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান ফজলুর রহমান। তিনি বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতিও ছিলেন।
রংপুর-৪ আসনে নৌকা প্রতীকে জয় পেয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি। ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনেও এই আসন থেকে জয়ী হন। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ১৯৮৫ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানি ব্যবসায় যুক্ত হন টিপু মুনশি। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম সেপাল গ্রুপ। ঢাকা-৩ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি। হামিদ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা নসরুল হামিদ।
ফরিদপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছেন হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ। তিনি এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি। তাঁর প্রতিষ্ঠান দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক শিল্পগোষ্ঠী।
শুধু তৈরি পোশাক খাতের অন্তত ১৫ জন ব্যবসায়ী এবারের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। সালমান এফ রহমান, টিপু মুনশি ও এ কে আজাদ ছাড়া রেনেসাঁস গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মো. শাহরিয়ার আলম (রাজশাহী-৬), পোশাক খাতের বিকেএমইএর সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান (নারায়ণগঞ্জ-৫), বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী (খুলনা-৪), ওয়েল গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম (চট্টগ্রাম-৮), শাশা ডেনিমের চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ (চট্টগ্রাম-৫), মণ্ডল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মমিন মণ্ডল (সিরাজগঞ্জ-৬), নিপা গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. খসরু চৌধুরী (ঢাকা-১৮), তুসুকা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়জুর রহমান (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫), ফেবিয়ান গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা তাজুল ইসলাম (কুমিল্লা-৯), স্প্যারো গ্রুপের চেয়ারম্যান চয়ন ইসলাম (সিরাজগঞ্জ-৬), স্মার্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবুর রহমান (চট্টগ্রাম-১৬)।
এ ছাড়া নির্বাচনে গাজী গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম দস্তগীর গাজী (নারায়ণগঞ্জ-১), সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবু জাফর মোহাম্মদ শফি উদ্দিন (কুমিল্লা-৬), আফিল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আফিল উদ্দিন (যশোর-১), জেমকন গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান কাজী নাবিল আহমেদ (যশোর-৩) প্রমুখ নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন।
হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে অন্তত ১৬ জনের ১০০ কোটি টাকার বেশি স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। এই ১৬ জনই পেশায় ব্যবসায়ী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকার সম্পদের মালিক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। ১৫ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের এই সংসদ সদস্য গাজী গ্রুপের চেয়ারম্যান। ১৫ বছরে তাঁর সম্পদ বেড়েছে ২৫ গুণ।
আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্পদের মালিক কুমিল্লা-৮ আসনের প্রার্থী আবু জাফর মোহাম্মদ শফি উদ্দিন। তিনি সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এসকিউ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান। তাঁর সম্পদের পরিমাণ ৩৭২ কোটি টাকার বেশি।
সরকারের মন্ত্রিসভার অন্তত একজন সদস্যের নিজ নামে বিদেশে একাধিক কোম্পানি থাকার প্রমাণ রয়েছে বলে জানিয়েছিল টিআইবি। এই মন্ত্রী ও তাঁর স্ত্রীর মালিকানাধীন ছয়টি কোম্পানি এখনো বিদেশে সক্রিয়ভাবে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা পরিচালনা করছে, যার মূল্য ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। এই মন্ত্রী তাঁর হলফনামায় বিদেশে থাকা সম্পদের ব্যাপারে তথ্য দেননি।
এ ছাড়া হলফনামায় দেওয়া তথ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলে জানায় টিআইবি। এসব তথ্য যাচাই করা যাদের দায়িত্ব, তারা কোনো ব্যবস্থা নেয় না।
কোভিড মহামারি ও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের অর্থনীতি কঠিন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছে, দ্রব্যমূল্য সব মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা, কর্মসংস্থান বাড়ানোসহ ১১টি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হবে। যার মধ্যে রয়েছে ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ানো, বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহে নিশ্চয়তার জন্য আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে ভারসাম্য রক্ষা, খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং এ ক্ষেত্রে ব্যাংক যাতে বিধি নির্ধারিত সঞ্চিতি রাখে, তা নিশ্চিত করা। ইশতেহার ঘোষণার অনুষ্ঠানে দুর্নীতি দমনে সরকারের অঙ্গীকারের কথাও তখন তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জনে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আগে সংস্কার আনা জরুরি বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজনীতি কাদের জন্য, তা নিয়ে দলের মধ্যেই আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। দল যদি মনে করে যে রাজনীতি রাজনীতিবিদদের জন্য, তাহলে সংস্কার করতে হবে। এই কাজ রাজনীতিবিদদের করতে হবে। নিজেদের স্বার্থে, দলের স্বার্থে ও গণতন্ত্রের স্বার্থে তাঁদের আয়নার সামনে দাঁড়াতে হবে।
অন্যদিকে অর্থনীতিতে যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তা মোকাবিলায় বড় ধরনের রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো রওনক জাহান বলেন, ‘আগামী দিনে অনেক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ আসছে। আমাদের কঠিন সংস্কারের পথে যেতে হবে। এটা করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে ভূমিকা নিতে হবে। আমাদের এখানে দৃশ্যমান উন্নয়নের কথা বলা হয়। কিন্তু আমি কিছু দৃশ্যমান সুশাসন দেখতে চাই। গণতান্ত্রিক জবাবদিহি দেখতে চাই।’