প্যাকেটজাত চিনি বাজার থেকে উধাও।খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে সরকারনির্ধারিত দামের চেয়ে ১৩ থেকে ১৮ টাকা বেশিতে।
মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি ৫০ টাকার নিচে নেমেছে
ব্রয়লার মুরগি কেজিপ্রতি ১৫০–১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে
পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া মাছের দর কেজিপ্রতি ১৬০–২০০ টাকা
দেশের চিনির বাজার এখনো অস্থিতিশীল। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়েও বেশি দামে ভোক্তাদের বাজার থেকে চিনি কিনতে হচ্ছে। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের পর তৈরি হওয়া ডলার ও জ্বালানিসংকটের কারণে গত বছরের জুলাই–আগস্ট থেকে চিনির বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। এ অবস্থায় গত সেপ্টেম্বরে সরকার প্রথমবারের মতো চিনির দাম বেঁধে দেয়। এরপর আরও দুই দফা দাম বাড়ায় সরকার। সংকট কাটাতে বাজারে চালানো হয় অভিযান। এত কিছুর পরও বাজারে চিনির সংকট কাটেনি।
বাজারে নতুন করে আবারও চিনির সংকট দেখা দিয়েছে। উধাও হয়ে গেছে প্যাকেটজাত চিনি। খোলা চিনির সরবরাহও সীমিত। নতুন করে চিনির বাজারে সংকট দেখা দিয়েছে মূলত দামের কারণেই। সর্বশেষ গত নভেম্বরে খুচরা পর্যায়ে প্যাকেটজাত প্রতি কেজি চিনির দাম ১০৭ টাকা বেঁধে দেয় সরকার।
কিন্তু ডলার–সংকট ও বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত চিনির দাম বেড়ে যাওয়ায় চিনিকলের মালিকেরা সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে বাজারে চিনি সরবরাহ করতে পারছেন না। পাইকারি বাজারেই প্যাকেটজাত প্রতি কেজি চিনির হাতবদল হচ্ছে ১০৮–১০৯ টাকায়। খুচরা পর্যায়ে আসতে আসতে এই দাম আরও ৫–৭ টাকা বেড়ে যাচ্ছে। তাতে খুচরা বাজারে আসতে আসতে প্যাকেটজাত প্রতি কেজি চিনির দাম পড়ছে ১১৫ টাকা পর্যন্ত।
‘মিলগুলোতে পর্যাপ্ত কাঁচামালের জোগান অব্যাহত রাখতে আমদানি ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে আরও আন্তরিক হতে হবে। ঋণপত্র খুলতে এখনো সমস্যা হচ্ছে। আমরা আশা করছি, বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুত এ সমস্যার সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।’গোলাম রহমান, বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ও দেশবন্ধু গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে কমে তাঁরা পাইকারি বিক্রেতাদের কাছ থেকে চিনি কিনতে পারছেন না। অথচ প্রতি কেজি চিনির প্যাকেটের গায়ের দাম ১০৭ টাকা। এ অবস্থায় ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি দাম নিতে পারছেন না খুচরা বিক্রেতারা। তাই প্যাকেটজাত চিনির পরিবর্তে তাঁরা খোলা চিনি বিক্রিতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। কারণ, খোলা চিনির বিক্রির ক্ষেত্রে ‘গায়ের দামের’ কোনো সমস্যা নেই।
সরকারের পক্ষ থেকে খোলা চিনির দামও বেঁধে দেওয়া আছে, সেটি প্রতি কেজি ১০২ টাকা। কিন্তু বাজারে চিনির সংকট থাকায় খুচরা বিক্রেতারা যে যেমন খুশি তেমন দাম আদায় করছেন ক্রেতাদের কাছ থেকে। গতকাল রাজধানীর মালিবাগ ও খিলগাঁও তালতলা বাজারে প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হয়েছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়। বাজারে চিনি কম, তাই বাড়তি দামে চিনি কিনতে বাধ্য হচ্ছেন ক্রেতারা। তাঁরা বলছেন, মিলমালিক থেকে শুরু করে পরিবেশক, পাইকারি বিক্রেতা ও খুচরা বিক্রেতারা মিলে চিনির বাজারে এ সংকট তৈরি করেছেন। তবে মিলমালিকেরা বলছেন, ডলার–সংকটের কারণে তাঁরা ঠিকমতো ঋণপত্র খুলতে পারছেন না। আবার যেটুকু পারছেন, তাতেও ডলারের চড়া দাম গুনতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসের তুলনায় ডিসেম্বরে অপরিশোধিত চিনি আমদানি ঋণপত্র উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। গত অক্টোবরে অপরিশোধিত চিনি আমদানি ঋণপত্র হয়েছিল ১ লাখ ৬৩ হাজার ৭৪৫ টন। নভেম্বরে আমদানি ঋণপত্র হয় ১ লাখ ৪২ হাজার ৩০২ টন। আর সর্বশেষ ডিসেম্বরে আমদানি ঋণপত্র হয়েছে মাত্র ৬৯ হাজার ৫২ টন অপরিশোধিত চিনি। অথচ ২০২১ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে প্রতি মাসে গড়ে ২ লাখ টনের বেশি অপরিশোধিত চিনি আমদানি ঋণপত্র হয়েছিল। আমদানি করা অপরিশোধিত চিনি পরিশোধনের পর তা প্যাকেটজাত করে বাজারে বিক্রি করেন চিনিকলের মালিকেরা।
‘পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় খাদ্যতালিকায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে। গত বছরটি বাজারের অস্থিরতার মধ্যেই কাটিয়েছি। নতুন বছরে বাজারে কিছুটা স্বস্তি মিলবে, সেই আশায় আছি।’আনারুল ইসলাম, রাজধানীর মালিবাগে বাজার করতে আসা
এদিকে আসন্ন পবিত্র রমজান মাস সামনে রেখে গত ডিসেম্বরে ব্যবসায়ীদের কম টাকা জমা দিয়ে চিনিসহ আট পণ্যের আমদানি ঋণপত্র খোলার নির্দেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও ঋণপত্র খুলতে হিমশিম খাচ্ছেন আমদানিকারকেরা। গত কয়েক মাসে চিনি আমদানির কেমন ঋণপত্র খোলা হয়েছে, তা জানতে যোগাযোগ করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হকের সঙ্গে। তিনি ঋণপত্র খোলার তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, ‘এসব তথ্য দেওয়া যাবে না। এতে বাজারে সংবেদনশীলতা তৈরি হবে। ঋণপত্র বেশি খুললে দাম কমবে, কম খুললে দাম বাড়বে।’
প্রতিদিন বাজারের পণ্যমূল্যের হিসাব সংরক্ষণকারী সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবেও ঢাকার বাজারে কেজি প্রতি চিনির দাম দেখানো হচ্ছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা। টিসিবির হিসাবে, এক বছর আগে রাজধানীতে প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ৭৫ থেকে ৭৮ টাকা। তাতে এক বছরের ব্যবধানে চিনির দাম বেড়েছে ৪৭ শতাংশের বেশি।
চিনি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ও দেশবন্ধু গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মিলগুলোতে পর্যাপ্ত কাঁচামালের জোগান অব্যাহত রাখতে আমদানি ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে আরও আন্তরিক হতে হবে। ঋণপত্র খুলতে এখনো সমস্যা হচ্ছে। আমরা আশা করছি, বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুত এ সমস্যার সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে বছরে চিনির চাহিদা ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। রোজায় এ চাহিদা আরও বেড়ে যায়। অথচ দেশে সব মিলিয়ে উৎপাদিত হয় মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টন। শুধু রোজার মাসে চিনির চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় আড়াই থেকে ৩ লাখ টন। চাহিদার বড় অংশই জোগান দেওয়া হয় আমদানির মাধ্যমে। রমজানে যাতে চিনির সংকট না হয়, সে জন্য আমদানি পর্যায়ে আরোপিত ৩০ থেকে ৩২ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার করে সহনীয় পর্যায়ের নিয়ে আসতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দেওয়া হবে বলে গত বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারে নিত্যপণ্যের যাতে কোনো সংকট তৈরি না হয়, সে জন্য সরকারকে নিয়মিতভাবে ঋণপত্র খোলা ও সরবরাহব্যবস্থা তদারকি করতে হবে। আর কোনো ব্যবসায়ী যদি বেশি লাভের আশায় বাজারে সংকট তৈরি করেন, তবে তাঁর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।’
বাজারে উচ্চমূল্যে স্থিতিশীল হয়ে আছে অধিকাংশ পণ্যের দাম। আটা, ময়দা, ডাল, সয়াবিনের মতো পণ্যের দাম এখনো চড়া। মাঝারি ও সরু চালের দামও বাড়তি। বাজারে আমন ধানের নতুন চাল আসায় মোটা চালের দাম অবশ্য কিছুটা কমেছে। মালিবাগ, খিলগাঁও ও তালতলা বাজারে গতকাল প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ছিল ৪৮ থেকে ৪৯ টাকা। গত সপ্তাহে এই দাম ছিল ৫০ থেকে ৫১ টাকার মধ্যে। সাম্প্রতিক সময়ে এ চালের দাম কেজিতে সর্বোচ্চ ৫৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। টিসিবির হিসাবে, এক বছর আগে মোটা চালের দাম ছিল সর্বনিম্ন ৪৫ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে দাম ১০ টাকা বেড়ে, সেখান থেকে এখন ৫ টাকা কমেছে।
এদিকে শীতের দাপট বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে শীতের সবজির দামও কিছুটা পড়তি। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে মানভেদে ফুলকপি ও বাঁধাকপি প্রতিটি ২০ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি শালগম, শিম, বেগুন, নতুন আলু, টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। মুলা, লাউয়ের দামও কমতি। তবে বেড়েছে কাঁচা মরিচের দাম। প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ ১২০ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও এ দাম ১০০ টাকার নিচে ছিল।
এ ছাড়া গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৭০০ টাকায়। ব্রয়লার মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে প্রতি ডজন ১২০ টাকায়। ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়। সোনালি মুরগির দাম ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা কেজি। মাছের মধ্যে পাঙাশ ও তেলাপিয়া বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ২০০ টাকা কেজিতে।
সবজির দাম কিছুটা কমলেও বাজারে খুব বেশি সুখবর নেই। তাই সাধারণ মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে চাপের মধ্যেই রয়েছে। রাজধানীর মালিবাগে বাজার করতে আসা আনারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় খাদ্যতালিকায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে। গত বছরটি বাজারের অস্থিরতার মধ্যেই কাটিয়েছি। নতুন বছরে বাজারে কিছুটা স্বস্তি মিলবে, সেই আশায় আছি।’