ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস বিশ্বজুড়ে একটি আর্থিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে থাকে। বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা ও বন্ধুপ্রতিম দেশ থেকে তারা সহায়তা পায়। এর মধ্যে নগদ অর্থ গাজায় পাঠাতে তারা টানেল ব্যবহার করে। কিছু ক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করে ক্রিপ্টোকারেন্সি। বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তাদের মতে, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর জন্য তারা এটা করে থাকে।
গাজা ভূখণ্ড শাসন করে হামাস। তবে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে ওই সব তহবিলের অর্থ পাওয়া তাদের জন্য আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
রয়টার্স জানিয়েছে, এ সপ্তাহের আরও আগের দিকে ইসরায়েলি পুলিশ জানিয়েছিল যে তারা বার্কলেস ব্যাংকের একটি হিসাব জব্দ করেছে, যেটি হামাসের জন্য অর্থ উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত। পুলিশ আরও জানিয়েছে, তারা ক্রিপ্টোকারেন্সি হিসাবও বন্ধ করেছে, যার মাধ্যমে দানের অর্থ জোগাড় করা হতো। কিন্তু কতগুলো হিসাব কিংবা কী পরিমাণ অর্থ জব্দ করা হয়েছে, সে সম্পর্কে তারা কিছু বলেনি।
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন, যা সংক্ষেপে হামাস নামে পরিচিত, সেটি ২০০৭ সাল থেকে গাজা ভূখণ্ডে একটি সরকার পরিচালনা করছে। সংগঠনটি যেভাবে অর্থ সংগ্রহ করে, তা বেশ জটিল। এর মধ্যে অনেক অর্থ সংগ্রহ করা হয় আইনিভাবে। আবার অনেক অর্থ আসে গোপনে।
ম্যাথু লেভিট সন্ত্রাস প্রতিরোধবিষয়ক সাবেক একজন মার্কিন কর্মকর্তা। তাঁর হিসাবে, হামাসের মোট বাজেট ৩০ কোটি ডলারের কিছু বেশি। এই অর্থের বড় অংশ আসে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর করারোপ থেকে। বাকি অর্থ আসে ইরান ও কাতারের মতো বিভিন্ন দেশ এবং নানা রকম দাতব্য প্রতিষ্ঠান থেকে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, হামাস অন্যান্য উপসাগরীয় দেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। এ ছাড়া, তারা সহায়তা পায় ফিলিস্তিনি নাগরিক, বিভিন্ন দেশে বাস করা লোকজন ও হামাসের প্রতিষ্ঠা করা নিজস্ব দাতব্য সংস্থা থেকে।
এই প্রতিবেদনের জন্য মন্তব্য পেতে রয়টার্স হামাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। তবে হামাস অতীতে বলেছে, তাদের দাতাদের ওপর আর্থিক বিধিনিষেধ আরোপ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বৈধ আন্দোলন নিষ্ক্রিয় করার একটি চেষ্টামাত্র।
যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মতো কিছু দেশ হামাসকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধে করেছে। ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ এড়াতে সংগঠনটি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ক্রিপ্টোকারেন্সি, ক্রেডিট কার্ড ও কৌশলী বাণিজ্য লেনদেন করে বলে মনে করেন ম্যাথু লেভিট ।
তবে এ বছরে হামাস জানিয়েছে, লোকসানের কারণে তারা ক্রিপ্টো ব্যবহার থেকে সরে আসবে। ক্রিপ্টোকারেন্সির হিসাবপদ্ধতির কারণে এসব লেনদেন শনাক্ত করা সম্ভব।
ব্লকচেইন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান টিআরএম ল্যাবস বলছে, যেসব সংঘাতে হামাস জড়িত ছিল, সেসব সংঘাতের পর ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ বেড়ে গিয়েছিল। ২০২১ সালের মে মাসের সংঘাতের পর হামাস–নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন ক্রিপ্টো ঠিকানায় চার লাখ ডলারের জোগান দেওয়া হয়েছিল।
তবে টিআরএম বলছে, গত সপ্তাহের সংঘাতের পর থেকে হামাসের সঙ্গে সম্পর্কিত সমর্থকেরা মাত্র কয়েক হাজার ডলার ক্রিপ্টোর মাধ্যমে দিয়েছে।
টিআরএমের মতে, দানের পরিমাণ অল্প হওয়ার একটা কারণ হতে পারে যে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ খুব দ্রুত এগুলো শনাক্ত করছে। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় হামাসের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন ঠিকানা থেকে ইসরায়েল যেসব ক্রিপ্টোকারেন্সি জব্দ করেছে, তার মূল্য ‘লাখ লাখ ডলার’।
২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ইসরায়েল ১৯০টি ক্রিপ্টো হিসাব জব্দ করেছে। তাদের অভিযোগ, এগুলো হামাসের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল।
জাহাজ ও ছদ্ম কোম্পানি
ক্রিপ্টো বা যেকোনো মাধ্যমেই হোক, হামাসের মিত্ররা গাজায় অর্থ পাঠানোর পথ জানে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ইরান প্রতিবছর হামাস ও বিভিন্ন ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীকে ১০ কোটি ডলার দেয়। যেসব পদ্ধতি এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে ছদ্ম কোম্পানির ব্যবহার, জাহাজের ভাড়ার জন্য লেনদেন ও মূল্যবান ধাতুর ব্যবহার।
এ বিষয়ে ইরান তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, তুরস্ক থেকে শুরু করে সৌদি আরব পর্যন্ত এমন কিছু গোপন কোম্পানি হামাস প্রতিষ্ঠা করেছে, যারা ৫০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ পরিচালনা করে। পরে গত বছরের মে মাসে এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে ইরানকে এ–ই বলে অভিযুক্ত করে আসছে যে তারা হামাসকে অস্ত্র সরবরাহ করে সহিংসতা উসকে দিচ্ছে। ইসরায়েলকে স্বীকৃতি না দেওয়া তেহরান সব সময় বলে আসছে যে তারা সংগঠনটিকে নৈতিক ও আর্থিক সমর্থন দেয়। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে ইরান। দেশটি নিজেকে মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে মনে করে।
এ ছাড়া, জ্বালানি সম্পদে বলীয়ান কাতার ২০১৪ সাল থেকে গাজায় শত শত কোটি ডলার দিয়েছে। একসময় কাতার গাজার একমাত্র বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনা এবং গরিব পরিবার ও হামাস পরিচালিত সরকারের কর্মচারীদের জন্য প্রতি মাসে তিন কোটি ডলার দিত।
কাতারের একজন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, ‘কাতার সবচেয়ে গরিব ফিলিস্তিনি পরিবারকে ১০০ ডলার করে দিচ্ছে। এ ছাড়া দিনের আরও বেশি সময় যাতে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়, সে জন্যও সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোর ‘স্থিতিশীলতা রক্ষা ও তাদের জীবনমান ধরে রাখতে’ কাতার সহায়তা করছে।
বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে কাতার বেশ জটিল সমীকরণ মেনে চলে। একদিকে ওই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মার্কিন সামরিক ঘাঁটি কাতারে রয়েছে; আবার তারা তালেবান ও এ ধরনের গোষ্ঠীকে সহায়তা দেয়। কোনো ধরনের বিবাদ হলে তা মেটানোর কাজও করে কাতার।
কাতারের অর্থ
কাতারের দেওয়া অর্থ আবার ইসরায়েলের মাধ্যমে গাজায় যায়। বিষয়টি সম্পর্কে জানে—এমন একটি সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। প্রথমে এই অর্থ ইলেকট্রনিক লেনদেনর মাধ্যমে কাতার থেকে ইসরায়েল পাঠানো হয়। এরপর ইসরায়েলি ও জাতিসংঘের কর্মকর্তারা নগদ অর্থ গাজা সীমান্তে হাতে হাতে পৌঁছে দিয়ে আসেন।
সহায়তা দরকার—এমন পরিবার ও গাজার সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে এরপর ওই অর্থ সরাসরি বিতরণ করা হয়। অর্থ পেয়ে প্রতিটি পরিবার বা ব্যক্তি একটি তালিকায় তাঁদের নামের পাশে সই করেন। এরপর ওই তালিকার একটি কপি যায় ইসরায়েলে, একটি জাতিসংঘে এবং সর্বশেষটি যায় কাতারে।
কাতারের কর্মকর্তা বলেন, ‘গাজা ভূখণ্ডে কাতারি সহায়তা ইসরায়েল, জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয় করে দেওয়া হয়।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় গাজার বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কাতার জ্বালানি সংগ্রহ করেছে ইসরায়েল থেকে। এ ছাড়া দেশটি মিসর থেকে তেল সংগ্রহ করে হামাসকে দিয়েছে, যাতে এই তেল বিক্রি করে সেই অর্থ বেতন হিসেবে দেওয়া যায়।
গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের স্টিভেন রেইমার মনে করেন, আনুষ্ঠানিকভাবে হামাস যে অর্থ পায়, তাতে আরও বিধিনিষেধ দেওয়ার চেষ্টা হলে তা খুব সীমিত সাফল্যের মুখ দেখবে। তিনি বলেন, ‘তাদের আর্থিক কৌশল এসব চেষ্টাকে বোকা বানানোর ক্ষমতা রাখে।’