বিটকয়েন
বিটকয়েন

বিটকয়েন কী, কীভাবে এর মালিক হওয়া যায়

যুক্তরাষ্ট্রকে ক্রিপ্টোকারেন্সির রাজধানী বানিয়ে বিটকয়েনের একটি কৌশলগত মজুত গড়ে তোলা হবে—প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার সময়েই এ ঘোষণা দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচনে জিতেছেন তিনি এবং এর পরপরই বিটকয়েনের রমরমা অবস্থা চলছে। দামের ক্ষেত্রে একের পর এক রেকর্ড গড়ে চলেছে এই ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা। একপর্যায়ে দাম ছাড়িয়ে যায় এক লাখ ডলার। বিটকয়েন নিয়ে এখন সত্যিকার এক উন্মাদনা চলছে দুনিয়াজুড়ে।

বিটকয়েন বলে অবশ্য বাস্তবে কোনো মুদ্রা নেই। এটি একটি ডিজিটাল মুদ্রা। বিটকয়েন কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কিংবা কোনো সরকার বা ব্যাংকের তদারকি ছাড়াই স্বাধীনভাবে কাজ করে। একটি পাবলিক লেজারে বিটকয়েনের সব লেনদেনের রেকর্ড রাখা হয় এবং এই লেজারের কপি পুরো বিশ্বে হাজার হাজার সার্ভারে সংরক্ষিত আছে। এগুলো পরিচিত নোড নামে। বিটকয়েনের যেকেনো লেনদেন নেটওয়ার্কে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং বিভিন্ন নোডের মধ্যে তা শেয়ার করা হয়।

কীভাবে এল বিটকয়েন

২০০৮ সালের আগস্টে ‘বিটকয়েন ডটকম’ এই ডোমেইন নাম কেনা হয়। পেছনের মূল ব্যক্তি সাতোশি নাকামোতো। সঙ্গে ছিলেন মারতি মালমি নামের আরেক ব্যক্তি। তবে সাতোশি নাকামোতো একজন অদৃশ্য ব্যক্তি, অর্থাৎ তিনি কে তা কেউ জানেন না। এমনকি তিনি একজন ব্যক্তি না-ও হতে পারেন। ওই ডোমেইনে তখন একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়। শিরোনাম ছিল ‘বিটকয়েন: আ পিয়ার-টু-পিয়ার ইলেকট্রনিক ক্যাশ সিস্টেম’।

ওই নিবন্ধে একটি তত্ত্ব ও একটি সিস্টেমের নকশা উপস্থাপন করা হয়। উদ্দেশ্য, এমন একটি ডিজিটাল মুদ্রা চালু করা, যেটি প্রতিষ্ঠান বা সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকবে। ওই নিবন্ধের লেখক সাতোশি নাকামোতো বলেন, ‘প্রচলিত মুদ্রার মূল সমস্যা হলো, একে কাজ করাতে হলে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। মুদ্রাকে হেয় না করতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিশ্বাস করতে হবে। তবে প্রচলিত মুদ্রার ইতিহাস হলো বিশ্বাস ভঙ্গের ইতিহাস।’

বিটকয়েন ডটকমে প্রকাশিত নিবন্ধে যে সফটওয়্যারের বর্ণনা দেওয়া হয়েছিল, পরের বছর সেটির কাজ শেষ হয়। আর বিটকয়েন নেটওয়ার্ক চালু করা হয় ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে। প্রথম বিটকয়েন ব্লকটি মাইন করা হয় ওই বছরের ৩ জানুয়ারি বা তারপরের কাছাকাছি কোনো তারিখে। এটি পরিচিতি পায় ব্লক জিরো হিসেবে।

বিটকয়েন মাইনিং কী

এটি জটিল একটি কাজ। সহজ ভাষায় বললে বিটকয়েন মাইনিং হলো নতুন বিটকয়েন তৈরির প্রক্রিয়া। অত্যন্ত জটিল ও খটমটে গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে হয়। একজন মাইনারকে ওই গাণিতিক প্রশ্নের জবাব পেতে হয় কিংবা তাঁকে জবাবের কাছাকাছি যেতে হয়। এ কাজে এখন অত্যন্ত শক্তিশালী ও দামি কম্পিউটার ব্যবহৃত হচ্ছে। মাইনাররা যে সমস্যার সমাধান করেন, সেটি হ্যাশ। যত বেশি বেশি মাইনার নেটওয়ার্কে যোগ দিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্ঠা করেন, সমস্যার সমাধান করা ততই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনেকটা খনি থেকে খনিজ পদার্থ তোলার মতো করে একটি বিটকয়েন যখন মাইন করা হয়, তখন ওই মাইনার বিটকয়েন পান। তিনি কী সংখ্যক বিটকয়েন পাবেন, তা আগেই ঠিক করা থাকে।

বিটকয়েন মাইন করার জন্য বিভিন্ন রকম হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়। প্রথমবারের মতো যখন বিটকয়েন ব্লকচেইন প্রকাশ করা হয়েছিল, তখন ব্যক্তিগত কম্পিউটার বা সাধারণ পিসি ব্যবহার করেই বিটকয়েন মাইন করা যেত। কিন্তু বিটকয়েন যত জনপ্রিয় ও দামি হয়েছে, ততই আরও বেশিসংখ্যক মানুষ নেটওয়ার্কে যোগ দিয়ে অনেকটা সাগর সেচে মুক্তা তোলার এ কাজে যোগ দিয়েছে। ফলে একেকটি হ্যাশের সমাধান ততই কঠিন হয়েছে।

আপনার যদি একেবারে নতুন একটি কম্পিউটার থাকে, তাহলে আপনি তা ব্যবহার করে দেখতে পারেন। কিন্তু সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ, নেটওয়ার্কে এমন একদল মাইনারের সঙ্গে আপনি প্রতিযোগিতা করছেন, যাঁরা প্রতি সেকেন্ডে ৭৪৫ কুইন্টিলিয়ন (কুইন্টিলিয়ন হলো ১০ লাখ ট্রিলিয়ন, যা লিখতে ১ এরপর ১৮টি শূন্য বসাতে হবে) হ্যাশ নিয়ে কাজ করছেন। বিটকয়েন মাইনিংয়ের জন্য বিশেষভাবে তৈরি কম্পিউটার হলো অ্যাপ্লিকেশন স্পেসিফিক ইন্টিগ্রেটেড সার্কিটস (এএসআইসি), যা প্রতি সেকেন্ড ৪০০ ট্রিলিয়ন (বা লাখ কোটি) হ্যাশ তৈরি করতে পারে। বিপরীতে একেবারে হাল আমলের একটি পিসি কাজ করতে পারে সেকেন্ডে ১০ কোটি হ্যাশ নিয়ে।

বিটকয়েন নিয়ে কিছু তথ্য: • প্রথম বিটকয়েনটি তৈরি হয় ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে। • ১৬ ডিসেম্বর প্রতিটি বিটকয়েনের দাম ওঠে রেকর্ড ১,০৭,০০০ ডলার। • যুক্তরাষ্ট্র, চীন, যুক্তরাজ্য, ভুটান ও এল সালভাদরের কাছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিটকয়েন আছে। • একজন মাইনার ব্লক তৈরিতে সফল হলে ৩ দশমিক ১২৫ বিটকয়েন আয় করেন (অক্টোবর ২০২৪)। • বিটকয়েন মাইনিংয়ে প্রতিবছর ১৬৬ দশমিক ৭৫ টেরাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়।

কিন্তু এই বিপুল কর্মযজ্ঞ করে যে বিটকয়েন পাওয়া যায়, তা কতটা লাভজনক হয়? উত্তর হলো, এটি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে, যেমন বাজারে কী দামে বিটকয়েন বিক্রি হচ্ছে। এর কারণ হলো, বিটকয়েন মাইনিং করা অত্যন্ত খরচসাপেক্ষও। হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের পেছনে যেমন বিপুল অর্থ খরচ করতে হয়, তেমনি খরচ আছে বিদ্যুতের পেছনেও। ৩ কোটি ৬৮ লাখ জনসংখ্যার দেশ পোল্যান্ডে এক বছরে যে পরিমাণ বিদ্যুতের ব্যবহার হয়, বিশ্বব্যাপী মাইনাররা তার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন বিটকয়েন মাইন করার পেছনে। এই খরচের কারণে অনেকে একসঙ্গে বসে মাইনিংয়ের কাজ করেন।

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বিটকয়েন মাইনিং করা হয় যুক্তরাষ্ট্রে, মোট বিটকয়েনের ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এরপর আছে চীন (২১ দশমিক ১ শতাংশ) ও কাজাখস্তান (১৩ দশমিক ২ শতাংশ)।

বিটকয়েন কি কেনা যায়

বিটকয়েন কিনতে পাওয়া যায়। এই ক্রিপ্টো মুদ্রা মাইন করার যে শ্রমসাধ্য ও ব্যয়সাপেক্ষ কাজ, তার তুলনায় অনেকটা সহজেই যে কেউ বিটকয়েন কিনতে পারেন। এর কেনাবেচার জন্য রয়েছে ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ। তবে বেশির ভাগ মানুষই একটি পুরো বিটকয়েন কিনতে পারেন না শুধু এর উচ্চ দামের কারণে। কিন্তু বিটকয়েনের খণ্ডাংশ কেনা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন প্রচলিত মুদ্রা বা ফিয়াট কারেন্সি, যেমন মার্কিন ডলার।

তবে মনে রাখতে হবে, বিটকয়েনে বিনিয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এর দাম খুব বেশি ওঠানামা করে। বিশ্বের অনেক দেশ থেকে বিটকয়েনে বিনিয়োগও করা যায় না। বিটকয়েনে বিনিয়োগ করার আগে এ–সংক্রান্ত আইনকানুন যাচাই করে নিতে হয়।

বিটকয়েনের হাভিং

বিটকয়েনের পেছনে রয়েছে ব্লকচেইন প্রযুক্তি। এ প্রযুক্তিতে পরিবর্তন আনা হয় হাভিংয়ের মাধ্যমে। উদ্দেশ্য, যে হারে বিটকয়েন উৎপাদিত হয়, সেটি শ্লথ করা। অর্থাৎ বিটকয়েনের উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া। আগেই ঠিক করা হয়েছে, সর্বোচ্চ ২ কোটি ১০ লাখ বিটকয়েন সৃষ্টি করা যাবে। মোটামুটি প্রতি চার বছর পরপর হাভিং করে বিটকয়েনের উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ বিটকয়েনের মাইনিং দ্বিগুণ কঠিন করা হয়। ২১৪০ সালের মধ্যে সব বিটকয়েন বাজারে চলে আসবে।

খুচরা বিটকয়েন

এক টাকাকে যেমন ১০০ পয়সায় ভাগ করা যায়, তেমনটি একটি বিটকয়েনকেও ভাগ করা যায়। বিটকয়েনের এক হাজার ভাগের এক ভাগকে বলা হয় মিলি। তবে সবচেয়ে ছোট ইউনিটটি হলো সাতোশি। একটি বিটকয়েনের ১০ কোটি ভাগের ১ ভাগ হলো ১ সাতোশি। সুতরাং কেউ যদি বিটকয়েনে কোনো পণ্য বা সেবার দাম দিতে চায়, তাহলে বিটকয়েনে খণ্ডাংশে দাম পরিশোধ করতে কোনো সমস্যা হয় না। বিটকয়েনের মালিকানা নির্ধারণের জন্য বিশেষ সংকেত ব্যবহার করা হয়, যাকে বলা হয় প্রাইভেট কি। বিটকয়েনের মালিককে এটি মনে রেখে প্রয়োজনমতো ব্যবহার করতে হয়। তবে এর জন্য ক্রিপ্টোকারেন্সি ওয়ালেট থাকতে হবে।