আন্তর্জাতিক বাণিজ্য

বিকল্প মুদ্রায় বহির্বাণিজ্যে যা করেছে রাশিয়া

পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভারত রাশিয়া থেকে কম দামে জ্বালানি তেল কিনছে। বাংলাদেশও বিকল্প ব্যবস্থায় তা করার চিন্তাভাবনা করছে।

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ
ফাইল ছবি: এএফপি

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বব্যবস্থার অনেক হিসাব-নিকাশই পাল্টে গেছে। রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর আর্থিক নিষেধাজ্ঞার কারণে নানা ধরনের বিকল্প নিয়ে এখন আলোচনা চলছে। এর মধ্যে বড় খবর হলো, ভারত তার ‘শত্রুদেশ’ চীনের মুদ্রা ইউয়ানে রাশিয়ার কাছ থেকে কয়লা কিনছে। রাশিয়াও বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর মুদ্রায় রিজার্ভ সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা এখন চীনা ইউয়ান, ভারতীয় রুপি ও তুর্কি লিরা কিনছে। লক্ষ্য, এই দেশগুলোর সঙ্গে নিজস্ব মুদ্রাবিনিময়ের মাধ্যমে বাণিজ্য করা।

বিশ্বজুড়ে আবারও মন্দার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বাস্তবতায় নিরাপদ মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলারের কদর বাড়ছে। ফলে উন্নয়নশীলসহ প্রায় সব দেশেই ডলারের বিনিময় মূল্য বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে ডলারকে পাশ কাটিয়ে অন্য মুদ্রায় বাংলাদেশ বাণিজ্য করতে পারে কি না, তা নিয়েও জোর আলোচনা চলছে।

পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে কম দামে জ্বালানি তেল কিনছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশও বিকল্প ব্যবস্থায় রাশিয়ার কাছ থেকে কম দামে তেল কেনার চিন্তাভাবনা করছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই তেলের দাম বাংলাদেশ কীভাবে পরিশোধ করবে।

ডলার বা অন্য কোনো হার্ড কারেন্সিকে (প্রধান আন্তর্জাতিক মুদ্রাসমূহ) এড়িয়ে দুটি দেশ নিজ নিজ মুদ্রায় বাণিজ্য করলে সেটাকে আর্থিক পরিভাষায় বলা হয় ‘কারেন্সি সোয়াপ’ বা মুদ্রাবিনিময়। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ যে–ই মুদ্রায় রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনবে, তা কোথা থেকে আয় করবে?

রাশিয়া পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ তেল রপ্তানিকারক। বিশ্লেষকেরা বলেন, এই সুবিধা রাশিয়া খুব ভালোভাবে কাজে লাগাচ্ছে। পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার পর দেশটি ইউরোপীয় ক্রেতাদের রুবলে গ্যাস কিনতে বাধ্য করেছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘোষণা অনুযায়ী, গ্যাসের বিদেশি ক্রেতাদের প্রথমে রাশিয়ার গাজপ্রম ব্যাংকে একটি বিশেষ হিসাব খুলতে হবে। তাঁরা ওই হিসাবে বিদেশি মুদ্রা জমা দেবেন। গাজপ্রম ব্যাংক ওই মুদ্রা রুবলে রূপান্তরের পর তা গ্যাসের মূল্য পরিশোধে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই বন্দোবস্তের মাধ্যমে তারা নিজেদের মুদ্রা রুবলের মান ধরে রেখেছে।

রাশিয়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মার্কিন ডলার থেকে নিজেকে অনেকটা সরিয়ে রেখে তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৈচিত্র্যময় করেছে। ডলারের বিকল্প হিসেবে দেশটি আগে থেকেই চীনের ইউয়ান ও অন্য কয়েকটি দেশের মুদ্রায় রিজার্ভ গড়ে তুলেছে।

১৯৯৭-৯৮ সালে এশিয়ায় যে আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছিল, তাতে অনেক দেশ এ ধরনের ‘স্ব-বিমা’র প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। এখন রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে এবং সে কারণে দেশটি তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে রুবলে রূপান্তর করার ক্ষমতা হারিয়েছে। কিন্তু তেল-গ্যাস মজুতের সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে রাশিয়া যেভাবে নিজস্ব মুদ্রাকে শক্তিশালী করছে, তা অন্যদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য

এদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে পণ্য কেনাবেচায় ডলারের পরিবর্তে ভারত নিজস্ব মুদ্রা রুপিতে লেনদেন করার উদ্যোগ নিয়েছে। ভারতের সঙ্গে আমদানি–রপ্তানি উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা যাতে রুপিতেই লেনদেন করতে পারেন, তার জন্য যাবতীয় আইনি বাধাও দূর করেছে সেই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই)।

তবে ভারত শুধু বাংলাদেশ নয়, আরও অনেক দেশের সঙ্গেই রুপিতে বাণিজ্য করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের মূল উদ্দেশ্য হলো, রাশিয়া ও ইরানের মতো মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা দেশগুলোর সঙ্গে মার্কিন ডলারকে এড়িয়ে রুপিতে বাণিজ্য করা। একই পদক্ষেপ বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও নিতে চায় তারা।

অবশ্য এবারই প্রথম নয়, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আরবিআইয়ের তৎকালিন গভর্নর রঘুরাম রাজন রুপির প্রোফাইল বাড়াতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যার একটা ছিল নির্দিষ্ট কিছু কিছু দেশের সঙ্গে বাণিজ্যে ‘রুপিবিনিময়’ চালু করা।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, রাশিয়ার কাছ থেকে অন্য মুদ্রায় তেল কেনার ক্ষেত্রে যেসব বিষয় মাথায় রাখতে হবে, ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও সেগুলো প্রযোজ্য।