এবারের ফুটবল বিশ্বকাপ কাতারে অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হলেও একদিক থেকে আগের সব আয়োজককে ছাড়িয়ে গেছে স্বাগতিক দেশটি। আর সেটি হলো, আয়োজন বাবদ খরচ।
এই বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রস্তুতি বাবদ এরই মধ্যে কাতার ৩০ হাজার কোটি ডলার খরচ করে ফেলেছে। প্রতিযোগিতা চলাকালীন খরচ আরও বাড়বে। অথচ ২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপ আয়োজন করতে খরচ করেছিল ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার, ২০১৮ সালে রাশিয়া ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার খরচ করেছিল। খবর দ্য ইকোনমিস্টের।
দ্য ইকোনমিস্টের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের বদৌলতে কাতারের অর্থনীতিতে ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের মতো যুক্ত হবে। দেশটি এ আয়োজনে যে খরচ করেছে, তা মূলত ব্যয় হয়েছে অবকাঠামো নির্মাণে। যার বড় অংশই খরচ হয়েছে মেট্রো নেটওয়ার্ক তৈরিতে। বিশ্বকাপের খেলা দেখতে ১৫ লাখ মানুষ এক শহর থেকে আরেক শহরে যাবেন। তাঁদের যাতায়াত সহজ করতে এই মেট্রোব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। তবে আয়োজকেরা বলছেন, এসব অবকাঠামো শুধু বিশ্বকাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, এগুলো বিশ্বকাপ শেষেও কাজে লাগবে। আর বড় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের ইতিহাসে দেখা যায়, এ ধরনের বড় আয়োজনে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি।
সুইজারল্যান্ডের লুসান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৬৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বকাপ ও অলিম্পিকের মতো ৩৬টি বড় আয়োজনের মধ্যে ৩১টি আয়োজন লাভজনক হয়নি। গবেষণায় যে ১৪টি বিশ্বকাপের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তার মধ্যে কেবল একটির আয়োজন লাভজনক ছিল। আর সেটি ছিল ২০১৮ সালে রাশিয়ার ফুটবল বিশ্বকাপ। ওই বিশ্বকাপ থেকে রাশিয়া ২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার মুনাফা করেছিল। মূলত বিশ্বকাপের প্রচারস্বত্ব বিক্রি করে এই মুনাফা করে দেশটি। তবে বিনিয়োগের বিপরীতে সেটা আবার খুব বেশি লাভজনক হয়নি, বিনিয়োগের বিপরীতে রাশিয়া ওই আয়োজন থেকে মুনাফা করেছিল মাত্র ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।
বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের সব খরচ আয়োজক দেশের ঘাড়ে বর্তায়। ফেডারেশন অব ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বা ফিফা কেবল প্রতিযোগিতার পরিচালনব্যয় নির্বাহ করে। অথচ রাজস্ব আয়ের বড় অংশই ফিফার ঘরে যায়। টিকিট বিক্রি, পৃষ্ঠপোষকতা, সম্প্রচার স্বত্ব—সবকিছুই থাকে ফিফার হাতে। গত বিশ্বকাপ থেকে ফিফা ৫৪০ কোটি ডলার আয় করে। এ আয়ের একটি অংশ বিভিন্ন দেশকে দেওয়া হয়েছে।
লুসান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় শুধু স্টেডিয়াম নির্মাণ, উপকরণ ও মানবসম্পদ বাবদ খরচকে হিসাবে ধরা হয়। কিন্তু একটি ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের সঙ্গে আরও অনেক পরোক্ষ ব্যয় থেকে যায় যেমন কাতারের মেট্রো কাঠামো, নতুন নতুন হোটেল তৈরি ইত্যাদি। কিছু কিছু কাঠামো আবার দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতির জন্য উপকারী। কিন্তু ব্যয়বহুল স্টেডিয়াম অনেক ক্ষেত্রেই পরবর্তীকালে অব্যবহৃত থেকে যায়। ফলে এ বিনিয়োগ অর্থনীতিকে খুব বেশি চাঙা করতে পারে না।
এই যখন বাস্তবতা, তখন এ ধরনের বড় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের বিষয়ে দেশগুলোর অনাগ্রহ তৈরি হবে, এটাই স্বাভাবিক। সে জন্য দেখা গেল, ২০১৬ সালের অলিম্পিক আয়োজনের জন্য মাত্র সাতটি শহর নিলামে অংশ নেয়। আর ২০২৪ সালের অলিম্পিক আয়োজনের নিলামে অংশ নিয়েছে মাত্র দুটি শহর।
তবে এ রকম ব্যয়বহুল আয়োজনের ইতিহাস খুবই নতুন। ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে মাত্র ১৬টি দল অংশ নেয়। ২০১৮ সালে করা হিসাব অনুযায়ী, ১৯৬৬ সালের আয়োজনে ফুটবলারপ্রতি মাথাপিছু ব্যয় হয়েছিল ২ লাখ ডলার। আর ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনে খরচের সেই অঙ্ক একলাফে উঠে গেল ৭০ লাখ ডলারে। প্রতিটি প্রতিযোগিতার জন্য নতুন স্টেডিয়াম নির্মাণ করার যে রীতি চালু হয়েছে, সে কারণেই ব্যয় এতটা বেড়েছে। এবার কাতারে সাত-আটটি নতুন স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে একটি স্টেডিয়ামও তৈরি করতে হয়নি।
এ তো গেল অর্থনীতির বিষয়, মর্যাদার দিক থেকেও কাতার আগের বিশ্বকাপ আয়োজকদের সমপর্যায়ে যেতে পারেনি। এ কারণে এই বিশ্বকাপের আগে ব্রিটিশ মিডিয়ায় যত আলোচনা হয়েছে, তার দুই-তৃতীয়াংশ আলোচনায় ছিল নেতিবাচক বা সমালোচনামূলক। এমনকি এই বিশ্বকাপে স্টেডিয়াম নির্মাণ করতে গিয়ে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের প্রায় সাত হাজার শ্রমিক মারা গেছেন, এ কারণেও কাতারের বদনাম হয়েছে। তা ছাড়া অ্যালকোহল ব্যবহার নিয়ে আয়োজকদের দ্বিচারিতাও সমালোচনার মুখে পড়েছে। তবে বিশ্বকাপ আয়োজনের মধ্য দিয়ে কাতার যে বড় আয়োজক হিসেবে নিজের নাম প্রতিষ্ঠা করল, সেটা তাকে প্রতিবেশীদের থেকে এগিয়ে রাখবে।