কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা নিয়ে ভীত হওয়ার কারণ আছে কি

সারা বিশ্বে এখন প্রযুক্তি নিয়ে শোরগোল চলছে। গত কয়েক বছর রোবট নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এখন আলোচনা শুরু হয়েছে চ্যাটজিপিটি নিয়ে—এগুলো সবই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত। ধারণা করা হচ্ছে, প্রযুক্তি মানুষের কাজ কেড়ে নেবে। তবে এর সঙ্গে অনেকেই আবার ভিন্নমত পোষণ করেন।

দ্য ইকোনমিস্টের চলতি সংখ্যার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব দেশে ব্যাপক হারে রোবট ব্যবহার করা হচ্ছে, যেমন জার্মানি, জাপান, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া, এসব দেশে এখন পর্যন্ত বেকারত্ব সমস্যা হয়ে ওঠেনি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এসব দেশে উৎপাদনশীল খাতে কর্মসংস্থান বেশি। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, যত বেশি রোবট, তত বেশি উৎপাদন।

এ ছাড়া বিশ্বের যেসব স্থানে পর্যাপ্ত শ্রমিক পাওয়া যায় না, সেখানে শ্রমিক–সংকট মোকাবিলায় রোবট খুবই সহায়ক হতে পারে বলে ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। যেসব খাতে দক্ষ শ্রমিক পাওয়া যায় না, সেখানে রোবট কাজে লাগানো যেতে পারে।

এটা ঠিক, যেসব কাজে বিশেষ বৃদ্ধিবৃত্তি বা বিশ্লেষণী জ্ঞানের প্রয়োজন নেই, সেই সব কাজ রোবট দিয়ে করানো হলে কিছু মানুষের কাজের সুযোগ নষ্ট হবে। কিন্তু রোবট একঘেয়েমিপূর্ণ কাজ করে দিলে মানুষের পক্ষে আরও চৌকস কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

একই সঙ্গে যেসব কাজ মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ও অতিরিক্ত শ্রমসাধ্য, সেই সব কাজ থেকে রোবট মানুষকে মুক্তি দিতে পারে। এতে মানুষের পক্ষে আরও স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করা সম্ভব।

রোবোটিকস নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সেল রোবটসের প্রেসিডেন্ট কিম পভলসেন দ্য ইকোনমিস্টকে বলেছেন, সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন। প্রযুক্তি মানুষকে আরও স্বস্তি দিতে পারে বলেই তিনি মনে করেন। তবে সে জন্য দরকার যথাযথ মানসিকতা।

এ ছাড়া সারা বিশ্বে মানবাধিকার নিয়ে সচেতনতার সৃষ্টি হচ্ছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে আরও মানুষকেন্দ্রিক হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। তাতে রোবট মানবসভ্যতার বড় সহায় হতে পারেই বলে মনে করেন কিম পভলসেন।

এই বাস্তবতায় বিশ্বের বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলো এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) গবেষণায় বিপুল বিনিয়োগ করছে। বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়েও এআই গবেষণাগার তৈরি হয়েছে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এআই গবেষণাগারে কাজ করেন বাংলাদেশি তরুণ সাফির আবদুল্লাহ।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের কাজ কেড়ে নেবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সাফির আবদুল্লাহ বলেন, ‘এ ধরনের প্রশ্ন অমূলক নয়। প্রযুক্তিগত পরিবর্তন মানেই কাজের প্রথাগত জগৎ বদলে যাওয়া। অতীতে আমরা দেখেছি, কিছু কাজ যেমন হারিয়ে যায়, তেমনি নতুন কাজ যুক্ত হয়। চ্যাটজিপিটির কথাই ধরা যাক। এটি জেনারেটিভ এআই প্রযুক্তি, যা এখনো বহুলাংশে মানুষের ওপর নির্ভরশীল। ইন্টারনেটে প্রাপ্য তথ্যভান্ডার দিয়ে একে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে, যাতে তা পরবর্তীকালে টেক্সট, স্পিচ বা ইমেজ জেনারেট করতে পারে।

বৃহৎ পরিসরে ভাষা প্রশিক্ষণ মডেলের বিভিন্ন পর্যায়ে তথ্য চিহ্নিত করাসহ বিভিন্ন কাজে মানুষের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। অর্থাৎ এআই কিন্তু কাজ নিয়ে গেল না, বরং এক অর্থে মানুষের জন্য কাজ “তৈরি” করছে।’

এই কাজে যুক্ত হওয়ার জন্য বহুমাত্রিক দক্ষতা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন সাফির আবদুল্লাহ। তাঁর মতে, এআই–সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত হতে কোডিং–দক্ষতা বা কম্পিউটার সায়েন্সের জ্ঞানের পাশাপাশি গণিত, পরিসংখ্যানসহ বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান প্রয়োজন। বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ সমস্যাই জটিল আর সেগুলো সমাধানে দরকার ইন্টারডিসিপ্লিনারি, অর্থাৎ বহুমাত্রিক জ্ঞান।

ভবিষ্যতের এআই–নির্ভর পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পড়বে ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের, অর্থাৎ একটি বিষয়কে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে পারার সক্ষমতা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এ বিষয়ে জোর দেওয়া হয় না বললেই চলে।

সাফির আবদুল্লাহ সতর্ক করে দেন, ‘আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রযুক্তি যেন তাদের মুনাফা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া না হয়।’

বর্তমানে অনেক বিশেষজ্ঞ বেকারত্ব সমস্যার সমাধানে কারিগরি শিক্ষার কথা বলেন। কিন্তু কারিগরি শিক্ষা বেকারত্ব সমস্যার সমাধান করতে পারে না বলে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে সাম্প্রতিক এক আলাপচারিতায় উল্লেখ করেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিবিদ অচিন চক্রবর্তী। তিনি বলেন, দরকার হচ্ছে শক্তিশালী বনিয়াদি শিক্ষা। দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, তারা উৎপাদনশীল খাতে এত ভালো করতে পেরেছে বনিয়াদি শিক্ষার কারণে। শক্তিশালী বনিয়াদি শিক্ষা থাকায় তারা নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে।

অচিন চক্রবর্তীর কথার সঙ্গে দ্য ইকোনমিস্টের তথ্যের মিল পাওয়া যাচ্ছে। সেটা হলো, অনেক বেশি রোবট ব্যবহার করলেও দক্ষিণ কোরিয়ায় বেকারত্ব বাড়েনি।

সবাই কি পারবে দক্ষতা উন্নয়ন করতে

কয়েক বছর ধরেই প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি ও শিল্পক্ষেত্রে অটোমেশনের প্রভাব নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে কোভিডের সময় প্রযুক্তির বিকাশ ও ব্যবহার আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। বলা হচ্ছে, প্রযুক্তির এই অভাবনীয় বিকাশের যুগে নিম্ন দক্ষতার মানুষের কাজ চলে যাবে। টিকে থাকতে হলে মানুষকে দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে।

কিন্তু দ্য গার্ডিয়ানের এক সংবাদে বলা হয়েছে, কত মানুষের পক্ষে এভাবে দক্ষতার উন্নয়ন ঘটিয়ে টিকে থাকা সম্ভব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও তার নির্মাতারা এত চৌকস যে তা খুব সহজেই মানুষকে ছাড়িয়ে যাবে, এমন সম্ভাবনা প্রবল। মানুষ যতই দক্ষতার উন্নয়ন করুক না কেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তার চেয়ে এগিয়ে থাকবে।

ইতিমধ্যে সৃজনশীল জগতে অনেক কাজই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা করে দিচ্ছে। ছড়া লেখা, বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল, বইয়ের অডিও ভাষ্য তৈরি—এসব কাজের জন্য মানুষের প্রয়োজন পড়ছে না। সাংবাদিকতার জগতেও তার প্রভাব পড়ছে। ইতিমধ্যে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শুরু হয়েছে। বাংলা ভাষায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ এখনো সেই পর্যায়ে যায়নি। ফলে দেশে এখনো এ নিয়ে বিশেষ শঙ্কার কারণ নেই বলেই ধারণা করা হচ্ছে; বরং অনুবাদের চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাবে, এমন সম্ভাবনা আছে।

এদিকে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এখনো বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষের বসবাস, সেখানে স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে কতটা দক্ষতার উন্নয়ন করা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এই পরিস্থিতিতে বনিয়াদি শিক্ষায় রাষ্ট্রের বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।