চীন
চীন

কীভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ছে চীনের অর্থনীতি

বছরের শুরুর দিকে চীন ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করে। এখন বছরের সপ্তম মাস চলছে। অর্থনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, চীন এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে বলে তাঁরা আশাবাদী।

সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক বৈঠকে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং বলেন, ‘প্রবৃদ্ধির এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সামর্থ্য ও আত্মবিশ্বাস—উভয়ই আমাদের আছে।’ তিনি আরও বলেন, চীনের বিশাল বাজার উন্মুক্ত; নতুন শিল্পের প্রভূত বৃদ্ধি ও নতুন নতুন চালিকা শক্তির কল্যাণে চীনের অর্থনীতি ধাবমান হবে।

সেই সঙ্গে বৈঠকে চায়না সোসাইটি অব ইকোনমিক ফোরামের প্রেসিডেন্ট পেং সেন বলেন, চীন যে ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে, সে বিষয়ে তাঁর পূর্ণাঙ্গ আত্মবিশ্বাস আছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক ব্লগপোস্টে এ কথা বলা হয়েছে।

১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে সংস্কার শুরু করার পর চীনের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। গত কয়েক দশকে চীনের মাথাপিছু উৎপাদনশীলতা ৩০০০ শতাংশ বেড়েছে। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এক বিস্ময়গাথা।

কিন্তু গত কয়েক বছরে চীনের অর্থনীতির গতি কমে গেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের ভাষ্য, ২০২৯ সালের মধ্যে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে। এটা যে শুধু চীনের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে হবে তা নয়, বরং বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির কারণেও এমনটা হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

এই পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীনের প্রবৃদ্ধির পালে হাওয়া লাগাতে নতুন নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে হবে। ব্লগপোস্টে অর্থনীতির নতুন কিছু ক্ষেত্রের কথা বলা হয়েছে, যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডিজিটাল আর্থিক সেবা ও বৈদ্যুতিক গাড়ির মতো পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি।

লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অর্থনীতির অধ্যাপক জিন কেউ বলেন, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির উন্নয়নে লাখ লাখ কোটি ডলার প্রয়োজন হবে। তিনি আরও বলেন, এ ক্ষেত্রে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

ইতিমধ্যে চীনের জিডিপিতে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির অবদান প্রভূত। ২০২৩ সালের চীনের প্রবৃদ্ধির ৪০ শতাংশই এসেছে এই খাত থেকে অর্থাৎ বৈদ্যুতিক গাড়ি, ব্যাটারি ও সৌর প্যানেল ইত্যাদি থেকে। এই খাতের গবেষণা ও উন্নয়নে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ গত পাঁচ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে।

চীনের অর্থনীতি নিয়ে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম গত মে মাসে অর্থনীতিবিদদের নিয়ে এক জরিপ করে। ওই জরিপে অংশ নেওয়া ৭৫ শতাংশ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, চীনের প্রবৃদ্ধির গতি কমে আসবে। জানুয়ারি মাসের জরিপে এ কথা বলেছিলেন ৬৯ শতাংশ অর্থনীতিবিদ।

উচ্চ হার থেকে উচ্চ মানের প্রবৃদ্ধি

২০১৭ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেছিলেন, চীন এত দিন উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে; কিন্তু এখন পালাবাদলের সময় এসেছে। চীন এখন উচ্চ হারের প্রবৃদ্ধি নয়, বরং উচ্চমানসম্পন্ন প্রবৃদ্ধির দিকে ধাবিত হবে।

এখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে উচ্চমানসম্পন্ন প্রবৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা বলেন, উচ্চমানসম্পন্ন প্রবৃদ্ধির মূল ভিত্তি হবে উন্নত প্রযুক্তি।

পেং সেন বলেন, চীনের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির চাকা সচল রাখতে উচ্চমানসম্পন্ন প্রবৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে। এই পুরো বিষয়টি নির্ভর করবে পরিবর্তনের ওপর—প্রযুক্তি খাতের পরিবর্তন। সেই সঙ্গে অর্থনীতির প্রথাগত খাতগুলোর হালনাগাদ হওয়া দরকার, তাদের গভীর পরিবর্তন দরকার।

উচ্চমানসম্পন্ন প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে যেসব খাত চালিকা শক্তির ভূমিকা পালন করবে, সেগুলো হলো জেনারেটিভ এআই, সেমিকন্ডাক্টর, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ইত্যাদি। বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করেন, সরবরাহব্যবস্থার দক্ষতা বজায় রাখা এবং বিশ্ববাজারের সুবিধা পাওয়াও এই উচ্চমানসম্পন্ন প্রবৃদ্ধির জন্য জরুরি।

ভূরাজনীতির ভূমিকা

বিশেষজ্ঞরা যে বাজারের কথা বলেছেন, তাতে ভূরাজনীতির প্রসঙ্গ চলে আসে। চীনের উন্নয়নের পরবর্তী ধাপ অনেকটাই নির্ভর করবে ভূরাজনীতির ওপর। কিন্তু যেভাবে পশ্চিমারা চীনকে একঘরে করার চেষ্টা করছে এবং বিশ্ব বাণিজ্যে যত রকম বাধা তৈরি করা হচ্ছে, তাতে চীনের ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমা হবে বন্ধুর।

কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ঈশ্বর প্রসাদ বলেন, ভূরাজনীতি অন্তর্নিহিতভাবে জিরো সাম গেম; অর্থাৎ যে খেলায় একপক্ষ যতটুকু জেতে, আরেক পক্ষ ঠিক ততটুকু হারে। কিন্তু এখন অর্থনীতির বেলায় দেখা যাচ্ছে, বিষয়টি জিরো সাম থেকে কখনো কখনো নেগেটিভ সাম হয়ে যাচ্ছে অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে কেউ তা থেকে লাভবান হচ্ছে না।

গত বছর আইএমএফের এক হিসাবে দেখা গেছে, অর্থনীতির এই খণ্ডিতকরণ ও বাণিজ্য–বাধার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতির বছরে ৭ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন বা ৭ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার ক্ষতি হচ্ছে। জিডিপি কমছে ৭ শতাংশের মতো।

এই পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চীনের দরজা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করে রাখা হোক এবং সারা বিশ্বের দরজাও যেন চীনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তা নিশ্চিত করা।