বিশ্বে ‘বিনিয়োগগুরু’খ্যাত ধনী ওয়ারেন বাফেট যখন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি শুধু আর্থিক হিসাব-নিকাশ নয়, অনেক ক্ষেত্রেই আচরণগত মনস্তত্ত্ব ব্যবহার করেন। আর এই আচরণগত মনস্তত্ত্বকে অন্তর্জ্ঞানমূলক বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি।
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিলিয়নিয়ার তথা শতকোটিপতি ওয়ারেন বাফেট সম্প্রতি তাঁর নিজের কোম্পানি বার্কশায়ার হাথাওয়ের বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) এমন অভিমতই ব্যক্ত করেছেন।
বাফেটের কাজ করার পদ্ধতি অন্যদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। তিনি কোনো উঠতি কোম্পানি নয়, বরং ডুবতে থাকা কোম্পানির শেয়ার কিনতেই বেশি আগ্রহী। যেমন ১৯৬২ সালে ওয়ারেন বাফেট প্রথম বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের শেয়ার কেনা শুরু করেছিলেন। তখন তিনি দেখেছিলেন যে কোম্পানিটির শেয়ারদর বাজার পরিস্থিতির তুলনায় কম। তবে যে প্রত্যাশা নিয়ে ওয়ারেন শেয়ার কিনেছিলেন, তা পূরণ হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা খারাপ হতে থাকে। কিন্তু একসময় এই কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেন তিনি; এরপর যা ঘটল, তা রীতিমতো ইতিহাস।
১৯৬৪ সালে বার্কশায়ার আমেরিকান এক্সপ্রেসের শেয়ার কেনে। তখন আমেরিকান এক্সপ্রেসের একটি কোম্পানি জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত। শেয়ারের দাম পড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় তিনি ওই কোম্পানির শেয়ার কেনেন। কিন্তু এরপরই কোম্পানিটির অবস্থা ঘুরে গেলে শেয়ারের দামও বাড়তে শুরু করে। বদৌলতে গত ৫০ বছরে তিনি এই কোম্পানি থেকে ২৫ হাজার ৯৬৬ শতাংশ লভ্যাংশ পেয়েছেন। একইভাবে ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের সময় গোল্ডম্যান স্যাকসের শেয়ার কেনেন বাফেট।
কীভাবে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাবক ভূমিকা পালন করে, সেটিও ব্যাখ্যা করেছেন ওয়ারেন বাফেট। বলেন, ‘অ্যাপলে যে আমি বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছি, তা নিয়ে সব সময়ই মানুষের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা ছিল, কী কারণে আমি অ্যাপলে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিলাম।’ তিনি আরও জানান, ভোক্তার আচরণের বিষয়ে কোম্পানির সঙ্গে তিনিও অনেক অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। এর মানে এই নয় যে তাঁর মনে হয়েছে, আসবাবপত্রের দোকান চালাতে পারবেন। কিন্তু বাল্টিমোরে আসবাবপত্রের চেইন কেনার পর তাঁরা এ বিষয়ে অনেক কিছু শিখেছেন।
বিষয়টি হলো, আসবাবপত্রের সেই ব্র্যান্ড কেনার পর খুব দ্রুতই বাফেট বুঝতে পেরেছিলেন, সিদ্ধান্তটি ভুল হয়েছে। কিন্তু এই ভুল তাঁদের বড় শিক্ষা হয়েছে। তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কী করা উচিত। ভোক্তাদের আচরণ সম্পর্কে বড় শিক্ষা হয় তাঁর সেই সময়।
এরপর বাফেট সি ক্যান্ডি নামের এক ক্যান্ডি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। তখন পর্যন্ত ক্যান্ডি বা চকলেট বানানোর অভিজ্ঞতা ছিল না তাঁর। বাস্তবতা হচ্ছে, সি ক্যান্ডিতে কাজ করার সময় ভোক্তার আচরণ সম্পর্কে বাফেটের জ্ঞানের গভীরতা বৃদ্ধি পায়। এরপর অ্যাপলের শেয়ার কেনার সময় সেই জ্ঞান ব্যবহার করেন বাফেট।
নিয়ম মেনে বছরে একবার বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের বার্ষিক সভা হয়। সেই সভার প্রতি দৃষ্টি থাকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নানা শ্রেণি–পেশার মানুষের। কারণ, প্রতিবছর এ সভা উপলক্ষে ওয়ারেন বাফেট একটি চিঠি লেখেন। ১৯৬৫ সাল থেকে তিনি প্রতিবছর চিঠি লিখে আসছেন। বলা হয়, বার্ষিক চিঠিতেই লুকিয়ে থাকে ওয়ারেন বাফেটের সর্বশ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ পরামর্শ। সে জন্য এই চিঠিকে বলা হয় সেরা বিনিয়োগ সাহিত্য।
১৯৬২ সালে ওয়ারেন বাফেট প্রথম বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের শেয়ার কেনা শুরু করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন যে এর শেয়ারদর বাজার পরিস্থিতির তুলনায় কম। তবে যে প্রত্যাশা নিয়ে ওয়ারেন শেয়ার কিনেছিলেন, তা পূরণ হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা খারাপ হতে থাকে। ১৯৬৪ সালে সিবারি স্ট্যানটন মৌখিকভাবে ওয়ারেনকে প্রস্তাব দেন যে তিনি সাড়ে ১১ ডলারে শেয়ারগুলো কিনে নেবেন, অর্থাৎ বাইব্যাক করবেন। তাতে বাফেট সম্মত হন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্ট্যানটন বাইব্যাকের যে নথি পাঠান, সেখানে শেয়ারের দর লেখা ছিল ১১ দশমিক ৩৭৫ ডলার। এতে বাফেট খুবই ক্ষুব্ধ হন। ফলে শেয়ার বিক্রি না করে বার্কশায়ারের আরও শেয়ার কেনার সিদ্ধান্ত নেন। উদ্দেশ্য ছিল, কোম্পানিটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্ট্যানটনকে শাস্তি দেওয়া। শেষ পর্যন্ত তা-ই করেছিলেন। মালিকানার কর্তৃত্ব নিয়েই স্ট্যানটনকে বরখাস্ত করেন বাফেট।