ডলারের বিনিময়ে সোনা। বিশ্বের অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঠিক এই কাজটিই এখন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে এসব দেশ পথ খুঁজছিল। ডলার ছেড়ে দিয়ে সোনার মজুত বাড়ানোই তাদের কাছে মনে হয়েছে সবচেয়ে নিরাপদ পথ।
কোন দেশ কী পরিমাণ সোনা মজুত করছে, তার হিসাব রাখা শুরু হয় ১৯৫০ সালে। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল বলছে, সেই সময়ের পর থেকে পাওয়া হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরই সবচেয়ে বেশি সোনার মজুত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। গোল্ড কাউন্সিল সোনাশিল্পকে প্রতিনিধিত্ব করে।
চলতি বছরে যা তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে এই ধারা এখনো চলছে বলে জানাচ্ছে বিবিসি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বৈশ্বিক বাণিজ্যে ডলার সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে। একই সঙ্গে এটি বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের প্রধান মুদ্রা। কিন্তু রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ বিশ্বব্যবস্থাকেই ঝাঁকি দিয়েছে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে ব্যবস্থা নিচ্ছে, দেখে মনে হয় তা ডলারের বিপক্ষে অবস্থান।
বিশ্লেষকেরা অবশ্য মনে করেন না যে আমূল কোনো পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। তাঁরা বলছেন, আরও অনেক বছর ডলার তার আধিপত্য বজায় রাখবে।
তবে যা ঘটছে, তার দিকে নজর রাখছেন সবাই। বড় অর্থনীতির দেশ, যেমন চীন, ভারত কিংবা ব্রাজিলের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সোনা কিনছে। বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে দ্রুত হারে তারা তাদের রিজার্ভে ডলারের পরিবর্তে সোনার মজুত যোগ করছে।
কিছু বিশ্লেষক বলছেন যে এই ধারা শুরু হয়েছে এমনকি রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের আগে থেকেই। তবে অনেকেই মনে করেন, যতটা সহজে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তা অনেক দেশকেই ডলার থেকে সরে যেতে উৎসাহিত করেছে।
তাদের মতে, বিশ্ব অর্থনীতি একটি বহু মেরু ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ দেওয়া হয় যে ডলারে রাখা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হার দুই দশকে ৭০ শতাংশ থেকে ৫৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার কথা বলা হয়। এ দেশটি সবচেয়ে বেশি নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রয়েছে। এখন তারা ডলারের বাইরে থেকে ব্যবসা–বাণিজ্য চালাচ্ছে এবং আরও বেশি সোনা কিনছে।
এসব দেশের প্রতিক্রিয়া যৌক্তিক। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ৩০ হাজার কোটি ডলারের রিজার্ভ জব্দ করতে পেরেছে। কারণ, এই মজুত ডলারে রাখা ছিল। ইসেড বিজনেস স্কুলের অর্থনীতির খণ্ডকালীন শিক্ষক ওমর রাশেদী বলেন, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের পর আমেরিকার পদক্ষেপের কারণে অনেক দেশ সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিষেধাজ্ঞার ভয়ে ডলারে রাখা সম্পদ কমিয়ে ফেলে। তাদের পছন্দ হয়ে দাঁড়ায় সোনা ও ইউয়ান।
বেসরকারি যেসব কোম্পানি রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা করে, তারা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার সম্ভাব্য শিকার হতে পারে বলে ভয় পাচ্ছে।
এ বছরের শুরু থেকে বিশ্ববাজারে সোনার দাম অনেকটা বেড়েছে। ডলারেই এর দাম বেড়েছে ১০ শতাংশের বেশি। বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান জুলিয়াস বায়েরের গবেষণাপ্রধান কারস্টেন মেনকে মনে করেন, এসব কারণেই বহু মেরুর একটি বিশ্বের কথা অনেকেই ভাবছেন। তাঁর লেখা একটি গবেষণা প্রতিবেদনে তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি, একটি বহু মেরুর বিশ্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো চলতি বছরেও সোনা কেনা চালিয়ে যাবে। তবে সেটা হয়তো আগের বছরের মতো রেকর্ড ভাঙবে না।’
তিনি বলেন, বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থা ডি–ডলারাইজেশন বা ডলারবিহীন করা নিয়ে যেসব কথাবার্তা হচ্ছে, তা নিয়ে তিনি খুব একটা ভাবছেন না। তবে তিনি মনে করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সোনা মজুত করার বর্তমান ধারাটি মূলত মার্কিন ডলারের বিপক্ষে একধরনের ‘নীতিবিবৃতি’।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সোনা পছন্দ করে কারণ উত্তাল সময়েও এই ধাতু তার মূল্য ধরে রাখে। মুদ্রা কিংবা বন্ডের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে না। আর সোনার দাম কোনো প্রতিষ্ঠান বা সরকারের ওপর নির্ভরশীল নয়। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সহজেই মার্কিন ট্রেজারি বন্ড এবং ডলারের বাইরেও বিনিয়োগ করতে পারে।
জর্জ মেসন ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক লরেন্স এইচ হোয়াইট বলেন, নানা কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সোনার মজুত গড়ে তুলতে পারে। তবে সম্ভবত প্রধান কারণ হলো, তারা তাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের অর্থ নানা দিকে বিনিয়োগ করতে চায়।
তিনি বলেন, ‘উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চীন একদিকে সোনা কিনছে, অন্যদিকে আবার তারা তাদের হাতে থাকা মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের একটা অংশ বিক্রি করে দিচ্ছে। ডলারের দাম কমে যাওয়ার যে ঝুঁকি থাকে, সেই ঝুঁকি থেকে খানিকটা হলেও নিজেদের মুক্ত রাখার একটা পথ হতে পারে সোনায় বিনিয়োগ।’
অধ্যাপক লরেন্স এইচ হোয়াইট বিশ্বাস করেন, আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের আধিপত্য থাকবে এবং ইউরো কিংবা ইউয়ান তার জায়গা নিতে পারবে না।
সুদের হার বেড়ে যাওয়ার কারণেও অনেক দেশ ডলার থেকে দূরে সরছে। ইসেড বিজনেস স্কুলের ওমর রাশেদী বলেন, মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়ানোর কারণে ট্রেজারি বিল মূল্য হারিয়েছে, তাই অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে যে তাদের বিনিয়োগে বৈচিত্র্য আনা দরকার।
সে কারণে অনেক দেশই ডলারের বাইরে ভিন্ন সম্পদে বিনিয়োগ করছে বলে তিনি ব্যাখ্যা করেন।
তবে ডলারের আধিপত্যের বিরুদ্ধে রাজনীতিবিদেরাও কথা বলেছন। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা ডা সিলভা সম্প্রতি চীন সফরের সময় ডলার থেকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘আমরা কেন নিজেদের মুদ্রায় বাণিজ্য করতে পারি না?’
স্পেনের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান এসগ্লোবালের বিশ্লেষক গনজালেস টোকা বলেন, ডলারের আধিপত্য দুর্বল হচ্ছে এবং এটা হতেই থাকবে। ইউরো ও ইউয়ানের উত্থান ঘটছে। ভবিষ্যতে রিজার্ভ ও বাণিজ্য লেনদেনে এই দুই মুদ্রার গুরুত্ব বাড়বে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ শুরু করার কথা বললেও ওয়াশিংটনের সঙ্গে বেইজিংয়ের এখানকার সম্পর্ক আগের মতো ততটা উত্তেজনাপূর্ণ নয়। অধ্যাপক রাশেদী মনে করেন, ডলারের প্রতি প্রধান চ্যালেঞ্জ আসবে ইউয়ান থেকে, কারণ বেইজিং তার রোড অ্যান্ড বেল্ট কর্মসূচির আওতায় যেসব ঋণ দিচ্ছে, সেসব ঋণ দেওয়া হচ্ছে ইউয়ানে, ডলারে নয়।
তবে তিনি এটাও মনে করেন, চীন যদি বিনিয়োগকারীদের জন্য সুম্পূর্ণ সুরক্ষামূলক পরিবেশ তৈরি না করে এবং যুক্তরাষ্ট্র যদি একটি অবাধ আর্থিক বাজার নিশ্চিত করতে ও মূল্যস্ফীতির হার স্থিতিশীল রাখতে পারে, তাহলে তাদের আধিপত্য আগামী এক দশক কিংবা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে বজায় থাকবে।