মোদিকে হেয় করতেই কি জি–২০ সম্মেলনে যাচ্ছেন না চীনা প্রেসিডেন্ট

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং
ছবি: রয়টার্স

ভারতে অনুষ্ঠিতব্য আগামী সপ্তাহের জি-২০-ভুক্ত দেশের শীর্ষ সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং যোগ দেবেন না, এমন খবর বেশ সাড়া ফেলেছে। এই বৈঠকের প্রস্তুতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন পশ্চিমা একটি দেশের এমন একজন কর্মকর্তা এই খবরে মন্তব্য করেছেন, ‘সারা বছর ধরে আমরা সবাই মিলে যে কাজ করেছি, তার সর্বনাশ করছেন তাঁরা।’

ওই কর্মকর্তার মতে, চীনা নেতার যোগদান না করা একটি সহজ বোধগম্য পদক্ষেপ।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সি নিজে জি–২০ সম্মেলনে অংশ নেবেন না; বরং প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং চীনের প্রতিনিধিত্ব করবেন, গণমাধ্যমে এমন খবর বেরিয়েছে। পশ্চিমা কর্মকর্তারা বলেছেন যে চীনের এই সিদ্ধান্তের কথা তাঁদের জানানো হয়েছে, যদিও বেইজিং এই খবর এখনো নিশ্চিত করেনি।

চীনা প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতি জি–২০-এর নতুন নেতা ভারত ও দিল্লি সম্মেলনের মর্যাদার প্রতি চপেটাঘাত হতে পারে। জি–২০-কে মনে করা হয় বিশ্বের শীর্ষ নেতৃত্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন। এই ফোরামের সদস্যদের মধ্যে যে ফাটল ধরেছে, তার মধ্যে চীনা প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতি এটিকে ঝাঁকি দেবে।

কয়েক মাস ধরেই অবশ্য জি–২০-এর মন্ত্রী পর্যায়ের বিভিন্ন বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছিল না। স্বাস্থ্যসুবিধা থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়ে মন্ত্রীরা একমত হতে পারছিলেন না। কারণ ছিল ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ধনী ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে কে কতটুকু দায়িত্ব পালন করবে, তা নিয়ে মতানৈক্য।

কিছু ভারতীয় বিশ্লেষক নিশ্চিত যে চীন তাদের আয়োজন করা এই ‘শোকেস’ সম্মেলন বরবাদ করতে চায়। তারা তা করতে চায় সীমান্তে দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষের কারণে। ভারতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান অনন্ত অ্যাসপেন সেন্টারের প্রধান নির্বাহী ইন্দ্রানী বাগচী বলেন, ‘প্রায় সব বিষয়েই ঐকমত্যের ক্ষেত্রে মূল বিরোধিতাকারী হলো চীন।’

সি হবেন প্রথম কোনো চীনা প্রেসিডেন্ট, যিনি জি–২০-এর একটি শীর্ষ সম্মেলনে গরহাজির থাকবেন। জি–২০ দেশগুলোর মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পার্থক্য আছে। কিন্তু তারপরও এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে একধরনের ঐকমত্য গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে।

প্রধানমন্ত্রী লি হলেন প্রেসিডেন্ট সির পরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা। কিন্তু ওয়াশিংটনে অবস্থিত আটলান্টিক কাউন্সিলের জিওইকোনমিকস সেন্টারের ঊর্ধ্বতন পরিচালক জশ লিপস্কির মতে, চীনা প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতি জি–২০-এর ‘দীর্ঘমেয়াদি টেকসই কার্যক্ষমতা ও সাফল্যের’ প্রতি একটি প্রশ্নের জন্ম দেবে।

জশ লিপস্কি বলেন, ‘একটা উদাহরণ দিই। জি–২০ যখন ঋণ পুনর্গঠনের দর-কষাকষি নিয়ে কথা বলবে, তখন কি চীনের সমর্থন নিয়ে তা বলবে? এটা জি–২০-এর ভবিষ্যতের প্রতি একটি হুমকি।’

জি–২০-এর প্রথম দুটি সম্মেলন হয়েছিল ২০০৮ ও ২০০৯ সালে। ওই সময় বিশ্বব্যাপী যে আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছিল, তার প্রতি সাড়া হিসেবে জি–২০-কে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর নীতিনির্ধারণীর কাঠামো মনে করা হয়েছিল। আর সেখানে চীনকে দেখা হয়েছিল ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা উন্নয়নশীল দেশগুলোর নেতা হিসেবে।

যুক্তরাজ্যে ২০০৯ সালে যে সম্মেলন হয়েছিল, সে সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন গর্ডন ব্রাউন। তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্ব একত্র হচ্ছে।’ কিন্তু ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে নিজের দেশের অংশ করে নেওয়া ও ইউক্রেনে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের পর পশ্চিমা বিশ্ব থেকে রাশিয়ার সরে যাওয়া জি–২০-এর ঐক্যে ফাটল ধরায়।

একই সঙ্গে শুরু হয় একটি নতুন বৈশ্বিক সংকট। পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা। ফলে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যকার ফাটল কেবল গভীরই হয়েছে।

বালিতে গত বছর অনুষ্ঠিত বৈঠকের শেষে জি–২০ অপ্রত্যাশিতভাবে একটি যৌথ ঘোষণা দিতে পেরেছিল। কিন্তু ভারতের সভাপতিত্বে যে সম্মেলন হতে যাচ্ছে, সেখানে ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে গণতান্ত্রিক বিশ্ব এবং রাশিয়া ও চীনের মধ্যে একটি অলঙ্ঘনীয় দেয়াল উঠছে বলে মনে করা হচ্ছে।

জি–২০ দেশগুলোর পররাষ্ট্র, অর্থ বিভাগের প্রধান ও অন্য কর্মকর্তাদের কোনো বৈঠক থেকেই ভারত একটি চূড়ান্ত ঘোষণা আদায় করতে পারেনি। যুদ্ধকে নিন্দা করে পশ্চিমা দেশগুলো যেসব বিবৃতি দিয়েছে, চীন ও রাশিয়া বারবার সেসব থেকে নিজেদের দূরে রেখেছে।

শীর্ষ সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সম্ভাব্য অনুপস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুক্রবার বলে, ‘সঠিক সময়ে’ তারা সফরসূচি সম্পর্কে জানাবে। বেইজিং এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী গ্যাসের নির্গমন কমাতে জি–২০-তে আনা প্রস্তাবে ঐকমত্য সৃষ্টিতে তারা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সি হয়তো শুরুতে ভেবেছিলেন, জি–২০-এর মাধ্যমে চীনের ভূরাজনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর কাজটি সহজ হবে। আদতে এই ফোরাম ধীরে ধীরে চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তিক্ত হয়েছে। অন্যদিকে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশ আরও কঠোর মনোভাব নিচ্ছে।

গবেষণা সংস্থা কার্নেগি চায়নার পরিচালক পল হায়েনলি বলেন, ‘এসব দেশের মধ্যে যারা জি–২০-এর সদস্য, তাদের অনেকেই কয়েক দশক ধরে চীনের ব্যাপারে তাদের অবস্থান শক্ত করেছে। সির জন্য এটি (জি–২০) একটি অনমনীয় শ্রোতামণ্ডলী।’

বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন যে তিনি এখনো আশা করছেন, সি চিন পিং সম্মেলনে যোগ দেবেন। এটি একটি ইঙ্গিত যে উন্নত দেশগুলোর জোট জি৭-এর বাইরেও সহযোগিতা বাড়াতে হোয়াইট হাউস আগ্রহী।

বাইডেন ও পশ্চিমা নেতারা যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের আওতায় নেওয়া অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মসূচির বিকল্প কর্মসূচি নিতে প্রস্তুত, সির অনুপস্থিতির ফলে তাঁরা হয়তো তা ঘটা করে দেখাতে পারবেন না।

চীনা প্রেসিডেন্টের পরিকল্পিত অনুপস্থিতি অবশ্য মাত্র কয়েক দিন আগে অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনে তাঁর সাড়ম্বর উপস্থিতির একেবারে বিপরীত ঘটনা। দক্ষিণ আফ্রিকাতে অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে সির উদ্যোগেই উন্নয়নশীল দেশের জোট ব্রিকসের সম্প্রসারণ ঘটে, মোট সদস্য হয় ১১। চীন ব্রিকসকে দেখে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার একটি প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসনে কর্মকর্তা ছিলেন ড্যানিয়েল প্রাইস। তিনি বলেন, ‘সম্মেলনে সির যোগদান না করার সিদ্ধান্ত স্পষ্টতই মোদির জি-২০ নেতৃত্বকে হেয় করার চেষ্টা। তবে একই সঙ্গে এটি ব্রিকসের মধ্যে সত্যিকার সংহতি না থাকাকে প্রকাশ করছে এবং এই জোটের সম্প্রসারণ নিয়ে যে প্রচারণা চলেছে, তার অসাড়ত্বও তুলে ধরছে।’

ড্যানিয়েল প্রাইস আরও বলেন, ‘ডলার ও মার্কিন নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কথা বলা এদের মধ্যে একমাত্র সাধারণ বিষয় বলে মনে হচ্ছে।’

চীনের ভাষ্যকারদের কাছে থেকে এমন ধারণা যাওয়া যাচ্ছে যে ব্রিকস ছাড়া জি-২০-এর চেয়েও অন্য যে ফোরামকে বেইজিং বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ মনে করে, সেটি হলো সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন। এই সংগঠনে অন্যতম সদস্য রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো।

গবেষণা সংস্থা কার্নেগি চায়নার পরিচালক পল হায়েনলি মনে করেন, ভারত সম্মেলনে সির অনুপস্থিতি যতটা না জি-২০-কে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হবে চীনের নিজের। ‘এই সিদ্ধান্ত জি-২০-এর কাছে থেকে কিছু কেড়ে নিতে পারবে না, বরং তা বৈশ্বিক ব্যবস্থায় নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় চীনের সক্ষমতা খর্ব করবে। জি-২০ কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে না।’