বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ভারতের ব্যবসা–বাণিজ্য কী ধরনের প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে, তা নিয়ে সে দেশে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ভারতের যেসব কোম্পনির বাংলাদেশে বড় ধরনের কার্যক্রম রয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকেরই কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে। তবে বাংলাদেশের ঘটনাবলিতে ভারতের পোশাক খাতের সুবিধা হতে পারে বলেও মনে করছেন দেশটির বিশ্লেষকেরা।
ইন্ডিয়া টুডে জানিয়েছে, বাংলাদেশের অস্থিরতা ভারতীয় বেশ কিছু কোম্পানির ওপর যে প্রভাব ফেলেছে, তা বোঝা যাচ্ছে শেয়ারবাজারে তাদের শেয়ারের দামের দিকে তাকালে। বাংলাদেশের সঙ্গে যেসব কোম্পানির উল্লেখযোগ্য ব্যবসা রয়েছে অথবা বাংলাদেশের বাজারে যাদের উপস্থিতি রয়েছে, সেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে।
শেখ হাসিনা ভারতের একজন ঘনিষ্ঠ মিত্র এ কথা উল্লেখ করে ইন্ডিয়া টুডে বলছে, তাঁদের প্রস্থান এই অঞ্চলের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতি ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
মারিকো: সাফোলা ভোজ্যতেলের জন্য সুপরিচিত মারিকো। এ ছাড়া শ্যাম্পু, শিশু সুরক্ষাপণ্য ও স্কিন কেয়ার পণ্য বিক্রি করে এই কোম্পানি। মঙ্গলবার ইন্ডিয়া টুডে জানায়, এই কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে ৪ শতাংশ। কোম্পানিটি তার আয়ের ১১ থেকে ১২ শতাংশ পায় বাংলাদেশ থেকে। তবে মারিকোর আন্তর্জাতিক ব্যবসার ৪৪ শতাংশই বাংলাদেশে বলে জানায় টাইমস অব ইন্ডিয়া।
বাংলাদেশের গাজীপুর ও চট্টগ্রামে মারিকোর তিনটি কারখানা রয়েছে। বুধবারে স্টক এক্সচেঞ্জে দেওয়া এক প্রতিবেদনে মারিকো জানিয়েছে, বাংলাদেশের বাজারে তাদের কার্যক্রম পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে, তবে তারা চলমান ঘটনার দিকে নজর রাখছে। কোম্পানিটি আরও আশা করছে যে তাদের উৎপাদন কার্যক্রম দ্রুত শুরু হবে।
পার্ল গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রিজ: এটি ভারতের একটি পোশাক তৈরির কোম্পানি। পার্ল গ্লোবাল তার আয়ের ২৫ শতাংশের মতো পায় বাংলাদেশ থেকে। কোম্পানিটি জানায়, তাদের শেয়ারের দাম ৩ শতাংশ কমে গেছে। কারফিউর সময় বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
ইমামি: এই কোম্পানির শেয়ারের দাম কমে ৪ শতাংশ। বাংলাদেশে ইমামির বড় ধরনের উপস্থিতি রয়েছে। অস্থিরতার কারণে এই কোম্পানির কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ইমামি বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি ও বাজারজাত করে, যার বেশির ভাগই ব্যক্তিগত ব্যবহারের পণ্য। এ ছাড়া রয়েছে নানা ধরনের স্বাস্থ্যসুরক্ষা পণ্য।
ইন্ডিয়া টুডে বলছে, আরও যেসব কোম্পানির বাংলাদেশে উপস্থিতি রয়েছে এবং ধকল পোহাচ্ছে, তাদের মধ্যে রয়েছে বায়ার কর্প, জিসিপিএল, ব্রিটানিয়া, ভিকাশ লাইফকেয়ার, ডাবুর, এশিয়ান পেইন্টস, পিডিলাইট, জুবিল্যান্ট ফুডওয়ার্কস ও বাজাজ অটো।
এ ছাড়া বাংলাদেশের অস্থিরতা ট্রেন্ট, পিডিএসন ও ভিআইপি ইন্ডাস্ট্রিজের জন্য বিশেষভাবে উদ্বেগের। কারণ, এসব ভারতীয় কোম্পানির সরবরাহব্যবস্থার বেশ খানিকটা অংশ বাংলাদেশের ওপর নির্ভর করে।
এদের মধ্যে ভিআইপি ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশ থেকে সফট লাগেজ, ব্যাকপ্যাক ও ডাফল ব্যাগের মতো পণ্য বাংলাদেশ থেকে সংগ্রহ করে। কোম্পানিটি বলেছে, যদি বাংলাদেশের পরিস্থিতি টান টান থাকে এবং রাজনৈতিক সংকট যদি দীর্ঘমেয়াদে ভারতের জন্য নেতিবাচক হয়, তাহলে তারা পণ্য সংগ্রহের কৌশল পাল্টে সম্ভবত ভারতের দিকেই নজর ফেরাবে।
ভিআইপি ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নীতু কাশিরামকা টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেন, ‘সফট লাগেজের চাহিদা কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বাংলাদেশে আমাদের কার্যক্রম কমিয়েছি।’ এই কোম্পানির সাতটি কারখানা রয়েছে মোংলা এলাকায়। কোম্পানিটি তাদের আয়ের ২০ থেকে ২৫ শতাংশের জন্য বাংলাদেশ থেকে নেওয়া পণ্যের ওপর নির্ভরশীল।
ফেভিকল তৈরির কোম্পানি পিডিলাইট ইন্ডাস্ট্রিজ বলেছে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি তাদের ব্যবসার ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলছে, সেটি তারা খতিয়ে দেখছে। তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি দ্রুতই ভালো হবে বলে আশা করেছেন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ভারত পুরি। বাংলাদেশে ফেভিকলের কারখানা আছে এবং এ দেশে তারা পণ্য বাজারজাত করে।
ডাবুর বলেছে যে তারাও বাংলাদেশের পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে। ডাবুরের বাংলাদেশে উৎপাদনব্যবস্থা রয়েছে এবং কোম্পানিটি এ দেশে পণ্য বিক্রি করে।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি করে ভারতের এনটিপিসি। তবে ভারতীয় রাষ্ট্রায়াত্ত খাতের এই কোম্পানির বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার খুব সামান্য অংশই তারা বাংলাদেশে বিক্রি করে। বাংলাদেশ বড় পরিমাণ বিদ্যুৎ আমদানি করে আদানি পাওয়ার লিমিটেডের কাছ থেকে। আদানির সঙ্গে করা চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে বলে মনে করে ইন্ডিয়া টুডে।
২০১৭ সালে করা চুক্তির আওতায় আদানি ২৫ বছর ধরে বাংলাদেশের কাছে ১,৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বিক্রি করার কথা। এই প্রকল্প চালু হয় ২০২৩ সালে। তবে আদানির বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রে সরবরাহ করা কয়লার দাম নিয়ে এর আগে প্রশ্ন উঠেছে। ইন্ডিয়া টুডে বলছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চুক্তি সংশোধন করার বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
বাংলাদেশের অস্থিরতা ভারতের বস্ত্র ও পোশাকশিল্পের জন্য মিশ্র পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ভারতীয় সুতার বড় গন্তব্য বাংলাদেশ। দেশটিতে উৎপাদিত সুতার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশই বাংলাদেশে যায়। বর্ধমান টেক্সটাইলসের যুগ্ম ব্যবস্থাপনা পরিচালক নীরাজ জৈন বলেন, বর্তমানে রপ্তানিতে খুব বেশি সমস্যা হচ্ছে না, তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটলে তা হবে তাঁদের জন্য উদ্বেগের বিষয়।
তবে বাংলাদেশের এই পরিস্থিতিতে সুযোগও খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে। ভারতীয় বস্ত্র ও তৈরি পোশাকশিল্প এই সুযোগে তাদের বাজার বাড়াতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আরএসবির ব্যবস্থাপনা অংশীদার চাকরি লোকাপ্রিয়া বলেন, ভারতের কোম্পানিগুলো যদি দ্রুত এগিয়ে আসে, তাহলে তারা বাজারের একটা অংশ দখল করতে পারবে।
গোকালদাস এক্সপোর্টস, কেপিআর মিল, আরভিন্দ লিমিটেড, এসপি অ্যাপারেলস, সেঞ্চুরি এনকা, কিটেক্স গার্মেন্টস ও নাহার স্পিনিংয়ের মতো কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে। অর্থাৎ তাদের জন্য বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ইতিবাচক হয়েছে।