বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতি কমলেও ঋণ বাড়ছে। ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সের (আইআইএফ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক ঋণের পরিমাণ গত বছর রেকর্ড ৩১৩ ট্রিলিয়ন বা ৩১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারে উঠেছে। অর্থাৎ বৈশ্বিক ঋণ এর আগে কখনো এই উচ্চতায় ওঠেনি।
আইআইএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর বৈশ্বিক ঋণের ভান্ডারে আরও ১৫ ট্রিলিয়ন বা ১৫ লাখ কোটি ডলারের বেশি অর্থ যোগ হয়েছে। ফলে মোট বৈশ্বিক ঋণ ৩১৩ ট্রিলিয়ন ডলারের নতুন রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে। তবে জিডিপির অনুপাতে বিভিন্ন দেশের সরকারের ঋণ টানা তৃতীয় বছরে কমেছে। শক্তিশালী বাজার অর্থনীতির কারণে এটা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক ঋণ ২০২২ সালে প্রায় ৭ ট্রিলিয়ন বা ৭ লাখ কোটি ডলার কমেছিল। পরিসংখ্যান অনুসারে, বৈশ্বিক ঋণ ২০২৩ সালে ১৫ ট্রিলিয়ন বা ১৫ লাখ ডলারের বেশি বেড়েছে। আইআইএফ জানিয়েছে, এক দশক আগে মোট বৈশ্বিক ঋণ ছিল ২১০ ট্রিলিয়ন ডলার।
কোভিড-১৯ মহামারির সময় বিশ্বব্যাপী পণ্য সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটে। ফলে দেশে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যায়। মহামারির প্রভাব কাটতে না কাটতে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের জের দুই বছরেও অনুভূত হচ্ছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এই যুদ্ধের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হবে। মহামারির সময় থেকে দেশে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে উদার হস্তে ঋণ ও প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। সে কারণে ২০২০ সাল থেকে বৈশ্বিক ঋণের বোঝা বাড়ছে।
মোট ঋণের প্রায় ৫৫ শতাংশ তৈরি হয়েছে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোয়; এর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জার্মানি। অন্যদিকে চীন, ভারত ও ব্রাজিলের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও ঋণ বৃদ্ধির ধারা দেখা গেছে।
উন্নত দেশগুলোর মোট ঋণ গত বছর ২০৮ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন বা ২০ হাজার ৮৩০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মোট ঋণ ১০৪ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন বা ১০ হাজার ৪৬০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে।
২০২৩ সালে বৈশ্বিক পারিবারিক ঋণের পরিমাণ ৫৯ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন বা ৫ হাজার ৯৩০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে বিভিন্ন দেশের সরকারি ঋণ—গত বছর যা ৮৯ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন বা ৮ হাজার ৯৯০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে।
আইআইএফ জানিয়েছে, আর্থিক খাতবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানের ঋণ ৯৪ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ ৬৯ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
ফিচ রেটিংস জানিয়েছে, ২০২২ সাল থেকে দেশে দেশে নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে ঋণের ব্যয় বেড়ে গেছে। এই বাস্তবতায় ঋণের জগতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।
বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, কোভিড-১৯ মহামারির পর থেকে চীনের সরকারি ঋণ জিডিপির এক-চতুর্থাংশ সমপরিমাণ বেড়েছে। সে দেশে গৃহস্থালি ও ব্যবসায়িক ঋণও বেড়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, চীন এখন ঋণসংকটে জর্জরিত; দেশটির আবাসন খাতে চলছে বড় ধরনের সংকট। আয়ের দিক থেকে চীন এখনো মধ্যম সারির হলেও ঋণের দিক থেকে ধনী দেশগুলোর কাতারে পৌঁছেছে চীন। এ ঋণ গুরুতর অর্থনৈতিক হুমকিতে পরিণত হতে পারে বলে অর্থনীতিবিদেরা সতর্ক করেছেন।
অর্থনীতিবিদেরা বলেন, কোনো দেশের ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেলে তার পক্ষে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও অবকাঠামোর মতো খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। ঋণের বোঝা বেড়ে গেলে এসব দেশ বৈশ্বিক আর্থিক সংকট ও ক্রমবর্ধমান সুদহারের মতো বহিঃস্থ আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলেও তাঁরা মনে করেন। সে জন্য ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের কথা বলেন বিশ্লেষকেরা।