বিটকয়েনের দাম রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে। সে খবরের পাশাপাশি অনেকেই এখন দৃষ্টি ফেরাচ্ছেন আসন্ন হাভিংয়ের দিকে। এর মানে হলো, কিছুদিন পরই বিটকয়েনের উৎপাদন কমে যাবে। আর ঠিক সে কারণেই এখন বিটকয়েনের দাম বাড়ছে কি না, তা নিয়েও জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে।
বিটকয়েনের ক্ষেত্রে ‘হাভিং’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। অর্থনীতির নিয়ম অনুসারে, বাজারে যে পণ্যের চাহিদা আছে, সেই পণ্যের সরবরাহ কমে গেলে দাম বেড়ে যায়। এখন প্রশ্ন হলো, বিটকয়েনের উৎপাদন ও সরবরাহ কমে যাবে এই প্রত্যাশায় কি দাম আরও বেড়ে যাবে, নাকি এটি হবে কেবলই একটি কারিগরি বিষয়। বাজারের ফটকাবাজেরা এই পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছেন কি না, তা নিয়ে এখন কথা হচ্ছে।
কিন্তু হাভিং বিষয়টি কী? এটি কী বিবেচনায় নেওয়ার মতো কোনো বিষয়? বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য নিয়ে এই বিশ্লেষণ।
হাভিং কী
বিটকয়েনের পেছনে রয়েছে ব্লকচেইন প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তিতে পরিবর্তন আনা হয় হাভিংয়ের মাধ্যমে। উদ্দেশ্য হলো, যে হারে বিটকয়েন উৎপাদিত হয়, সেটি শ্লথ করা। অর্থাৎ বিটকয়েনের উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া।
সাতোশি নাকামোতো নামের এক লোক বিটকয়েনের ডিজাইন করেছিলেন। এটি তাঁর ছদ্মনাম। তিনিই বিটকয়েনের সৃষ্টিকর্তা। সাতোশি নাকামোতো ঠিক করেছিলেন, সর্বোচ্চ ২ কোটি ১০ লাখ বিটকয়েন সৃষ্টি করা যাবে। হাভিং করার কোডও লিখেছিলেন নাকামোতো। ঠিক করেছিলেন, নতুন বিটকয়েন তৈরি ধীরে ধীরে কমে যাবে।
এখন পর্যন্ত ১ কোটি ৯০ লাখ বিটকয়েন বাজারে এসেছে।
কীভাবে এটা ঘটে
ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে তথ্যের রেকর্ড তৈরি করা হয়। এগুলোর পরিচিতি ‘ব্লক’ হিসেবে। আর চেইনে বা শৃঙ্খলে এই ব্লক যোগ করা পদ্ধতি পরিচিত ‘মাইনিং’ হিসেবে।
জটিল সব অঙ্কের সমাধান করে ব্লকচেইন তৈরি করা হয়। মাইনাররা তাদের হিসাব-নিকাশের শক্তি এ কাজে ব্যবহার করেন। আর পুরস্কার হিসেবে তাঁরা পান নতুন বিটকয়েন। তবে যখন হাভিং হয়, তখন মাইনারদের জন্য পুরস্কারের পরিমাণ অর্ধেক হয়ে যায়। এর ফলে মাইনিংয়ে আগের চেয়ে কম লাভ হয়, সঙ্গে নতুন বিটকয়েনের উৎপাদনও ধীর হয়ে পড়ে।
এভাবে হয়তো বিষয়টি বুঝিয়ে বলা যেতে পারে: ধরা যাক, বাসায় কাজ করার জন্য দুজন লোককে আপনি নিয়োগ দিলেন এবং তাঁদের পারিশ্রমিক হিসেবে আপনি টাকা বা অন্য কোনো বিনিময় মুদ্রা দেবেন। ঠিক সেই প্রক্রিয়া এখানে ব্যবহার করা হয়। যাঁরা মাইনিং করেন, তাঁদের পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় বিটকয়েন।
সেই পুরস্কার কীভাবে দেওয়া হবে, তার জন্য সাতোশি নাকামোতো দুটি নিয়ম করেছিলেন। প্রথম নিয়ম হলো, পৃথিবীতে ২১ মিলিয়ন বা ২ কোটি ১০ লাখের বেশি বিটকয়েন থাকতে পারবে না। অর্থাৎ এর বেশি কেউ আর বিটকয়েন বানাতে পারবে না।
দ্বিতীয় নিয়মটি হলো, যখন ২ লাখ ১০ হাজার ব্লক তৈরি হবে, তখন পুরস্কারের পরিমাণ অর্ধেক হয়ে যাবে। অর্থাৎ তখন হাভিং করা হবে।
পরের হাভিং কখন হবে
এর জন্য নির্দিষ্ট কোনো তারিখ নেই। তবে প্রত্যাশা করা হচ্ছে, পরের হাভিং হবে এপ্রিল মাসে। দেখা গেছে, ২ লাখ ১০ হাজার ব্লক চেইনে যোগ হতে মোটামুটি চার বছর সময় লাগে; সে জন্য বিটকয়েন হাভিং প্রতি চার বছর পরপর হয়ে থাকে।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, ২০১২ সালে প্রথম বিটকয়েনের হাভিং হয়েছিল; তখন প্রতিটি ব্লকের জন্য পুরস্কার ৫০ বিটকয়েন থেকে কমিয়ে ২৫ বিটকয়েন করা হয়। এরপর দ্বিতীয় হাভিং করা হয় ২০১৬ সালে। তখন পুরস্কার আরও কমিয়ে সাড়ে ১২ বিটকয়েন করা হয়। ২০২০ সালের মে মাসে যা আরও কমে মাত্র ৬ দশমিক ২৫ বিটকয়েনে নেমে আসে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এপ্রিল মাসে যে হাভিং হতে যাচ্ছে, তার পুরস্কার আরও কমে ব্লকপ্রতি ৩ দশমিক ১২ বিটকয়েনে নেমে আসবে।
দামের সঙ্গে কী সম্পর্ক
বিটকয়েনের পরিমাণ ২ কোটি ১০ লাখে সীমিত রাখার কারণ হলো অর্থনীতির সেই মূল কথা—চাহিদা ও সরবরাহে ভারসাম্য রাখা। যদি বিটকয়েনের সরবরাহ সীমাহীন হতো বা বিটকয়েন যত খুশি তত উৎপাদন করা যেত, কোনো প্রকার হাভিং না থাকত, তাহলে অনেক বিটকয়েন বাজারে চলে আসত। ফলে বিটকয়েনের দাম এত বেশি থাকত না।
অনেক বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ী বলেন, বাজারে বিটকয়েনের পরিমাণ কম থাকলে তার দাম বাড়ে। তবে মাইনারদের অনেকেই হাতে থাকা বিটকয়েন বিক্রি করেন না। যদি তাঁরা বেশি পরিমাণে বিটকয়েন বিক্রি করতেন, তাহলে এর দাম হয়তো কমে আসত।
বিটকয়েনের দাম কেন বাড়ে, সেটা জানা সত্যিই কঠিন। একটি কারণ হলো, এই কেনাবেচায় স্বচ্ছতা কম। কে কিনছে, কেন কিনছে, এটা জানা অনেক সময় সম্ভব হয় না।
সাম্প্রতিক সময়ে বিটকয়েনের দাম বাড়ার একটি কারণ হিসেবে মনে করা হয় বিটকয়েন ইটিএফের অনুমোদনের বিষয়টিকে। যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন জানুয়ারিতে বিটকয়েন-ভিত্তিক ইটিএফ অনুমোদন করে। একই সঙ্গে মনে করা হচ্ছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমাবে।
আগের হাভিংয়ে কী ঘটেছিল
এমন কোনো প্রমাণ নেই যে কেবল হাভিংয়ের কারণেই বিটকয়েনের দাম বেড়েছিল। কিন্তু তারপরও বিশ্লেষক ও বিটকয়েনের কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা হাভিংয়ের সঙ্গে দামের একটা সম্পর্ক খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।
২০২০ সালের ১১ মে যখন সর্বশেষ হাভিং হয়, তার পরের সপ্তাহে বিটকয়েনের দাম ১২ শতাংশ বেড়েছিল। কিন্তু ওই বছরেরই শেষের দিকে বিটকয়েনের দাম অনেকটা বেড়ে যায়। তখন এর জন্য মুদ্রানীতির পরিবর্তন, ঘরে থাকা বিনিয়োগকারীদের ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ বাড়ানো—এমন অনেক কারণকেই দায়ী করা হয়েছিল।
২০১৬ সালে হাভিংয়ের পরের সপ্তাহে বিটকয়েনের দাম বেড়েছিল ১ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পরই আবার এই ক্রিপ্টোকারেন্সির দাম পড়ে যায়।
বিটকয়েনের দাম এখন সর্বকালের রেকর্ড উচ্চতায়। গত অক্টোবর মাসের পর থেকে এখন পর্যন্ত বিটকয়েনের দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশের বেশি; ৪৪ শতাংশ বেড়েছে কেবল ফেব্রুয়ারি মাসে।
তবে অনেক বিশ্লেষক বিটকয়েনের দাম বাড়ার সঙ্গে হাভিংয়ের সম্পর্ক থাকার বিষয়টি পুরোপুরি উড়িয়ে দেন না। এবারে কী হবে, তা নিয়ে কেবল জল্পনা-কল্পনা করাই চলে। বিটকয়েনের দাম এমনিতেই বেশি, তাই এপ্রিল মাসের হাভিংয়ের পর এই ভার্চ্যুয়াল মুদ্রার দাম কোথায় ওঠে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।