অবশেষে সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে নীতি সুদ কমাল যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ। যা ধারণা করা হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি হারে কমানো হয়েছে নীতি সুদ। কোভিড মহামারির পর অর্থাৎ গত চার বছরের মধ্যে এই প্রথম নীতি সুদ কমানো হলো।
এক ধাপে শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট নীতি সুদ কমানো হয়েছে। যদিও সিংহভাগ মানুষের ধারণা ছিল, শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশীয় পয়েন্ট হারে নীতি সুদ কমানো হবে। এত দিন নীতি সুদহার ছিল ৫ দশমিক ২৫ থেকে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ; গত দুই দশকের বেশি সময়ের মধ্যে এটি ছিল সর্বোচ্চ। এখন তা ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে নেমে এল।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, অর্থনীতি জগতে ফেডের এই সিদ্ধান্ত বিগত কয়েক বছরের মধ্যে বড় মাইলফলক। দুই বছর ধরে ফেড উচ্চ মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে যে লড়াই করছিল, এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে সেই লড়াইয়ে তাদের বিজয় ঘোষিত হলো বলে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
নীতি সুদ কমানোর পর এক ঘোষণায় ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল বলেন, একবারে শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট হারে নীতি সুদ হ্রাস করার মধ্য দিয়ে ফেড নতুন ধারার সূচনা করল—বিষয়টি সে রকম কিছু নয়। বিষয়টি হলো ফেড অর্থনীতি ও বিশেষ করে শ্রমবাজার ভালো অবস্থায় রাখতে চায়।
ফেডের এই ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার চাঙা হয়েছিল; কিন্তু দিন শেষে তিনটি সূচকই পয়েন্ট হারিয়ে নেতিবাচক ধারায় নেমে গেছে।
চলতি বছরের শুরুতেই ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদহার কমানোর পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে বছরের প্রথম প্রান্তিকে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে গেলে ফেড সেই পরিকল্পনা থেকে সরে আসে। শেষমেশ সেপ্টেম্বর মাসে এসে তারা নীতি সুদহার কমাল।
এখন ফেড কর্মকর্তাদের পরিকল্পনা, চলতি বছরের শেষ নাগাদ নীতি সুদহার ৪ দশমিক ৪ শতাংশে নামিয়ে আনা। যদিও জুন মাসে তাঁদের ধারণা ছিল, বছর শেষে নীতি সুদহার ৫ দশমিক ১ শতাংশে নেমে আসবে। এরপর ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ নীতি সুদহার তাঁরা আরও ১ শতাংশীয় পয়েন্ট কমিয়ে ৩ দশমিক ৪ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করেছেন।
২০২১ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে শুরু করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে জ্বালানির দাম অনেকটা বেড়ে যায়। মূল্যস্ফীতির সূচক তখন একদম খাড়া ওপরের দিকে উঠে যায়। যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির হার ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায়। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে ফেডারেল রিজার্ভ আগ্রাসীভাবে নীতি সুদহার বাড়াতে শুরু করে। পরিণামে মূল্যস্ফীতি কমেছে—৯ শতাংশের ঘর থেকে এখন তা ২ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে।
গত আগস্ট মাসেই ফেডের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল বলেছিলেন, নীতি সুদ কমানোর সময় এসেছে। তনি আরও বলেন, মহামারির সময় থেকে যে মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করে, সেই সময় যুক্তরাষ্ট্র পেরিয়ে এসেছে। এ বিষয়ে ফেডের আত্মবিশ্বাস ক্রমেই বাড়ছে। জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতির হার ২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে আসার কারণেও এই আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। যদিও পাওয়েল বলেছেন, কবে ও কী হারে এই নীতি সুদহার কমানো হবে, তা নির্ভর করবে তথ্য-উপাত্তের ওপর।
এরপর আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ২ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসে; অর্থাৎ ফেডারেল রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা ২ শতাংশের কাছাকাছি চলে আসে মূল্যস্ফীতির হার। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পর এটাই যুক্তরাষ্ট্রের সর্বনিম্ন মূল্যস্ফীতি। এরপর আর ফেডের সন্দেহের অবকাশ থাকেনি যে মূল্যস্ফীতি টেকসইভাবে ২ শতাংশের ঘরে নেমে আসছে। সে কারণেই তাদের এই সিদ্ধান্ত।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সুদহারের প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্রর নীতি সুদের ওপর বিশ্ব অর্থনীতি অনেকাংশে নির্ভর করে। যুক্তরাষ্ট্রে নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে ট্রেজারি বন্ডের সুদহার বৃদ্ধি পায়। ফলে বিনিয়োগকারীরা আর টালমাটাল সময়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগে আগ্রহী হন না। তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করে সুদ আয় করার দিকে বেশি নজর দেন। বন্ডে বিনিয়োগ বেড়ে গেলে বিশ্বজুড়ে হার্ড কারেন্সি হিসেবে ডলারের সংকট তৈরি হয়। ফলে ডলারের বিনিময়মূল্য বাড়ে; দেশে দেশে স্থানীয় মুদ্রার দরপতন হয়।
বিশ্লেষকেরা বলেন, নীতি সুদ কমায় এখন দেশে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে। ডলারের বিনিময় মূল্য ইতিমধ্যে কিছুটা কমেছে।
নীতি সুদ কী
কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সুদহারে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে স্বল্প সময়ের জন্য ঋণ দেয়, সেটাই নীতি সুদহার। ইংরেজিতে একে বলে রেপো রেট। রেপোর বাংলা হচ্ছে পুনঃক্রয় চুক্তি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে এটি পরিচিত। অর্থনীতিতে নগদ তারল্যের জোগান দিতে বা অন্যভাবে বলতে গেলে ব্যাংকগুলোর জরুরি প্রয়োজনে অর্থ সরবরাহ করতে মুদ্রানীতির এ হাতিয়ার ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই হাতিয়ার ব্যবহার করে।
নীতি সুদহার বাড়ানো হয় মূলত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য। নীতি সুদহার বেশি থাকলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে নিরুৎসাহিত হয়। এতে সমাজে অর্থের সরবরাহ কমে। চাহিদা কমলেও মূল্যস্ফীতিও কমে আসে—এটাই সাধারণ নিয়ম।
নীতি সুদহার বুঝতে হলে রিভার্স রেপো রেটের আলোচনাও সামনে চলে আসবে। যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি মনে করে বাজারে অতিরিক্ত তারল্য আছে, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই তারল্য তুলে নেয়। এ জন্যও একটি নির্দিষ্ট সুদের হার থাকে। অর্থ তুলে নেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সুদের হার দেয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে, তাকে বলা হয় রিভার্স রেপো। সাধারণত নীতি সুদহার বা রেপো রেটের তুলনায় রিভার্স রেপোর সুদহার কম থাকে।