মহামারির পর, অর্থাৎ ২০২০ সালের পর ২০২৪ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি হবে সবচেয়ে কম। বিশ্বব্যাংকের এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে ২ দশমিক ৪ শতাংশ। উচ্চ নীতি সুদহারের প্রভাবে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে বলে বিশ্বব্যাংকের ধারণা।
বিশ্বব্যাংক মনে করছে, ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যের সংকট বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। পরিস্থিতি এতই সঙিন যে ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর ২০২০ সাল ব্যতীত এবারের সম্ভাব্য ২ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি।
তবে গত বছর যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাশাতীত ভালো করায় প্রবৃদ্ধি হতে পারে ২ দশমিক ৬ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রধান অর্থনীতিবিদ ইন্দরমিত গিল বিবিসিকে বলেন, স্বল্প মেয়াদে প্রবৃদ্ধির হার কমে যাবে, ফলে বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোসহ অনেক দরিদ্র দেশ ফাঁদে পড়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি এখন ঐতিহাসিকভাবে মাঝারি পর্যায়ে। সেই সঙ্গে বিশ্ববাণিজ্যের প্রবৃদ্ধিও কমে গেছে।
বিশ্বব্যাংকের ষাণ্মাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল-হামাস সংকটের কারণে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বেড়ে গেছে। এতে আরও বলা হয়েছে, লোহিত সাগরের জলপথে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের হামলার কারণে জাহাজ চলাচলের ব্যয় বেড়ে যাবে, পরিণতিতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাবে।
এদিকে মধ্যপ্রাচ্য সফররত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের ভাষ্যেও মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা উঠে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে তিনি লিখেছেন, হুতি বিদ্রোহীদের হামলার কারণে ২০ শতাংশ জাহাজ ঘুর পথে চলাচল করছে। এতে খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ ও মানবিক সহায়তা পরিবহনের ব্যয় বেড়ে গেছে।
এমন সময়ে এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে, যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছিল যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। টানা প্রায় দুই বছর ধরে নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরো অঞ্চলে মূল্যস্ফীতির হার তাদের লক্ষ্যমাত্রা ২ শতাংশের কাছাকাছি চলে এসেছে। ফলে এ বছর সুদহার কমানো হবে বাজারে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছে।
বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোতে উচ্চ সুদহারের কারণে দরিদ্র দেশগুলোতে ঋণের ব্যয় বেড়েছে। বিশেষ করে বিশ্বের দরিদ্রতম ৭৫টি দেশে তা কোন পরিস্থিতিতে আছে, সে বিষয়ে বিশ্বব্যাংক বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন।
বিশ্বব্যাংক বলছে, এ বাস্তবতায় দরিদ্র দেশগুলোর তুলনায় উন্নত দেশগুলো মহামারির প্রভাব ভালোভাবে কাটিয়ে উঠতে পারছে।
ইন্দরমিত গিল বলেন, ‘আমরা ধারণা করছি, ২০২৪ সালের শেষে উন্নত দেশগুলোর মানুষের মাথাপিছু আয় প্রাক্-কোভিড সময়কে ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু একই সময়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাথাপিছু আয় প্রাক্-কোভিড সময়ের ৭৫ শতাংশে নেমে যাবে; এমনকি দরিদ্রতম দেশগুলোতে তা ৬৬ শতাংশে নেমে যাবে।’
বিশ্বের দরিদ্রতম মানুষের জন্য খাদ্যের দাম বিশেষ উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। ভারত চাল রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করায় ২০২৩ সালে চালের দাম ২৭ শতাংশ বেড়েছে। তবে অন্যান্য খাদ্যশস্যের যথেষ্ট প্রাপ্যতা থাকায় ২০২৪ সালে সামগ্রিকভাবে খাদ্যের দাম ১ শতাংশ কমবে।
উদ্বেগের আরেকটি কারণ হলো, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনের মানুষের ভোগব্যয়ের আকাঙ্ক্ষা কমে যাওয়া, যে কারণে দেশটিতে পণ্যমূল্য কমে যাচ্ছে। দেশটির আবাসন খাতে বিপুল ঋণের বোঝা তৈরি হলেও বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস, ২০২৪ সালে চীনের প্রবৃদ্ধি হবে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ।
চীনের বিচারে প্রবৃদ্ধির এই হার কম এবং ২০২৩ সালে তারা যে ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, তার চেয়ে কম। চীনে বিদেশি কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। তবে চীনের এ পরিণতি শুধু সে কারণে নয়, বরং দেশটির বয়স্ক জনগোষ্ঠী বেড়ে যাওয়া এবং গত ২০ বছরে তারা যে ধারায় উন্নয়ন করেছে, তার গতি ধরে রাখতে না পারার কারণে এ পরিণতি হচ্ছে।
ইন্দরমিত গিল বলেছেন, চীনের প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়া অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়েছে, বিশেষ করে যারা চীনের বড় বাণিজ্য অংশীদার, তাদের জন্য।
সামগ্রিকভাবে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে অর্ধদশকের বিচারে গত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হবে।
তবে আশার কারণও আছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, সরকার যদি বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে পারে, তাহলে প্রবৃদ্ধির পালে হাওয়া লাগবে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনসহ জ্বালানি খাতে পালাবদলের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।