জার্মান গাড়ি কোম্পানি ফক্সওয়াগন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পুনরায় স্থিতিশীল হওয়ার যে চেষ্টা করছিল, তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন নীতিগত অঙ্গীকারের কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ট্রাম্প যে আমদানি করা গাড়িতে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন এবং বৈদ্যুতিক গাড়ির (ইভি) জন্য ভর্তুকি বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন, ফক্সওয়াগনের ইভি কৌশলের ক্ষেত্রে তা বড় ধাক্কা।
ফক্সওয়াগনের পক্ষে মার্কিন গ্রাহকদের বৈদ্যুতিক যানবাহনের প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। ইউরোপের বাজারের গতি কমে গেছে; এ পরিস্থিতিতে তারা ভেবেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ঢুকবে। কিন্তু হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে তাদের সেই আশায় গুড়ে বালি। খবর ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের
গত পাঁচ বছরে চীনের বাজারে ফক্সওয়াগনের হিস্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে; পাশাপাশি ইউরোপের বাজারেও চাহিদা কমেছে। এ অবস্থায় মার্কিন বাজারে সাফল্য অর্জন করা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গাড়ি কোম্পানির জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
এর আগে কার্বন নিঃসরণের তথ্য-উপাত্ত জালিয়াতি করার কারণে ফক্সওয়াগন ব্র্যান্ডের সুনাম নষ্ট হয়েছে। মার্কিন বাজারে তার প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ফক্সওয়াগনের প্রতিযোগী, যেমন টেসলা, ফোর্ড ও জেনারেল মোটরসের তুলনায় তাদের অবস্থান অনেক দুর্বল।
এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও লক্ষ্য নিয়ে দ্বিধা নেই ফক্সওয়াগনের। উত্তর আমেরিকা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে কোম্পানিটি ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলে, ‘এটা স্পষ্ট যে ভবিষ্যৎ যুগ হতে চলেছে বৈদ্যুতিক গাড়ির যুগ; আমরাও সেদিকে এগোচ্ছি, তবে আমাদের শুরুর দিকের কৌশলে ভুল ছিল।’
ফক্সওয়াগন তাদের নতুন বৈদ্যুতিক গাড়ি আইডি-৪ দিয়ে মার্কিন বাজারে ঢোকার চেষ্টা করেছে। এই মডেলকে ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। তবে টেনেসির কারখানায় বছরে ১ লাখ ইউনিট উৎপাদনের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও চলতি বছর তারা মাত্র ১৭ হাজার গাড়ি বিক্রি করতে পেরেছে। গ্রাহকদের অভিযোগ ছিল, গাড়িটি খুব ছোট এবং মার্কিন গ্রাহকদের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে মানানসই নয়। এ অবস্থায় মার্কিন বাজারে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে ফক্সওয়াগনকে নতুন কৌশল ও গাড়ির ডিজাইনে পরিবর্তন আনতে হতে পারে।
এর মধ্যে আরেকটি ঘটনায় ফক্সওয়াগন বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে ফক্সওয়াগন তাদের আইডি-৪ মডেলের উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই মাসে তারা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিক্রি হওয়া ৯৮ হাজার ইউনিট গাড়ি প্রত্যাহার করে; কারণ, বৃষ্টির সংস্পর্শে গাড়ির বৈদ্যুতিক দরজার হ্যান্ডেল কাজ করছিল না। আগামী বছরের প্রথম ভাগের আগে উৎপাদন পুনরায় শুরু করা সম্ভব হবে না।
তবে গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে ফক্সওয়াগন ব্র্যান্ডের বিক্রয় ৯ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ৩ লাখ ২৯ হাজার ইউনিটে উঠেছে। এই বৃদ্ধির প্রধান চালিকা শক্তি ছিল তাদের প্রচলিত এসইভি, যেমন অ্যাটলাস ও বৃহৎ আকারের তিগুয়ান মডেলের গাড়ির বিক্রয় বৃদ্ধি।
ফক্সওয়াগন গ্রুপ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যাশিত রাজস্বের তুলনায় ১০০ কোটি ডলারের বেশি ঘাটতিতে আছে। একই সময় তাদের প্রধান ব্র্যান্ডের মুনাফার পরিমাণও কমছে। এ পরিস্থিতিতে ফক্সওয়াগনের আমেরিকা অঞ্চলের প্রধান নির্বাহী পাবলো ডাই সাইয়ের দিকে পুরো গাড়িশিল্প তাকিয়ে আছে।
তবে আইএইচএস মার্কিটের বিশ্লেষক স্টেফানি ব্রিনলি বলেছেন, এসব সমস্যার জন্য পাবলোকে দোষারোপ করা অন্যায় হবে; কারণ, তিনি কেবল ফক্সওয়াগন গ্রুপের নির্দেশনা অনুসরণ করছেন। সেটা হলো বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারে জোর দেওয়া।
এই কঠিন সময়ে বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন, ফক্সওয়াগন কীভাবে ট্রাম্পের সম্ভাব্য ইভি ভর্তুকি বাতিল ও শুল্কনীতির মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য কোম্পানিটিকে কৌশলগত পরিবর্তন ও কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন নীতি ফক্সওয়াগনের মার্কিন কৌশলকে কঠিন করে তুলেছে। তিনি ইভি ভর্তুকি বাতিল এবং আমদানি করা গাড়ির ওপর ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করেছেন। এই নীতি ফক্সওয়াগনের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেবে এবং পরিণামে তারা আরও প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্র বৈদ্যুতিক গাড়িতে ভর্তুকি দেয়। তবে ট্রাম্প এই ভর্তুকি বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছেন। এই নীতি বাস্তবায়িত হলে ফক্সওয়াগনের পক্ষে আইডি-৪ দিয়ে বাজারে প্রবেশের চেষ্টা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া মেক্সিকো বা অন্যান্য দেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক বৃদ্ধি এবং সরবরাহব্যবস্থায় সম্ভাব্য পরিবর্তনের জেরে ফক্সওয়াগনের মার্কিন কার্যক্রম সীমিত হবে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ফক্সওয়াগন অনেক দিন ধরেই মার্কিন বাজারের হিস্যা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে এই লক্ষ্য পূরণ করা তাদের জন্য সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং ছিল। ফক্সওয়াগন বলেছে, তাদের প্রধান ব্র্যান্ডের গাড়ির সরবরাহ গত তিন ত্রৈমাসিকে যুক্তরাষ্ট্রে ১৭ শতাংশ বেড়েছে, উচ্চ সুদের হার ও বাজারের ধীরগতি সত্ত্বেও। এ থেকেই প্রমাণিত হয়, মার্কিন বাজার নিয়ে তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনার ভবিষ্যৎ আছে।
যুক্তরাষ্ট্রে সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করছে ফক্সওয়াগন। চলতি মাসে ক্যালিফোর্নিয়ার ইভি স্টার্টআপ রিভিনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ শুরু করেছে তারা।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ফক্সওয়াগন যতই চেষ্টাচরিত্র করুক না কেন, মার্কিন বাজার চীনের মতো লাভজনক হতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে চীনের বাজারের বিকল্প নেই। মার্কিন বাজার কঠিন জায়গা; এর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও প্রতিযোগী আছে।