যেসব কারণে ভেস্তে যেতে পারে সৌদি আরবের বৈদ্যুতিক গাড়ির স্বপ্ন

সৌদি আরব বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরির প্রতিযোগিতায় নাম লেখাতে চায়। কিন্তু নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার কারণে দেশটির বৈদ্যুতিক গাড়িশিল্প খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারছে না। দেশটি এখন পর্যন্ত বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাণে কয়েক শ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু অবকাঠামো, মেধা ও কাঁচামালের সংকটের কারণে তারা দাঁড়াতে পারছে না। এসব সমস্যা ও সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, সৌদি আরবের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান দেশটির অর্থনীতিকে তেলনির্ভরতা থেকে বের করে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছেন। তার অংশ হিসেবে সৌদি আরব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক লুসিড মোটরসে ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। সেই সঙ্গে নিজেদের ব্র্যান্ড সিয়ার তৈরির পাশাপাশি বৈদ্যুতিক গাড়ির জন্য ধাতুর কারখানা তৈরি করেছে।

সৌদি আরবের পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (পিআইএফ) থেকে এই বৈদ্যুতিক গাড়িশিল্পে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। তাদের লক্ষ্য, ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে পাঁচ লাখ বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরি করা। এ ক্ষেত্রে এর আগের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০২৬ সালের মধ্যে বছরে দেড় লাখ গাড়ি তৈরি করা।

এখন পর্যন্ত সৌদি আরবের গাড়িশিল্প তেমন একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠিত নিজেদের কারখানায় এখন পর্যন্ত তারা ৮০০ গাড়ি সংযোজন করতে পেরেছে, যেগুলোর যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা থেকে।

তবে শুধু বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্ষেত্রে নয়, এর আগেও সৌদি আরব গাড়িশিল্পে নাম লেখাতে গিয়ে সফল হতে পারেনি। ২০১৯ সালে জাপানের টয়োটা কোম্পানি সৌদি আরবের সঙ্গে গাড়ি তৈরির চুক্তির প্রস্তাবে না করে দেয়। শ্রমিকের অত্যধিক মজুরি, স্থানীয় সরবরাহ সংকট ও স্থানীয় বাজার ছোট—এসব কারণকে তখন তারা দায়ী করেছিল।

বিশ্ব অর্থনীতি এখন ফসিল বা জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানি থেকে সরে আসছে, যে জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানি বিক্রি করে সৌদি আরবের অর্থনীতি এতকাল ধরে ফুলেফেঁপে উঠেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব সমস্যা রয়ে গেছে এবং সেই সঙ্গে এখন গাড়ির বাজারে প্রতিযোগিতা তীব্র আকার ধারণ করেছে। ফলে সৌদি আরব এখন তেলনির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে উঠেপড়ে লেগেছে।

বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারে বিশেষ করে চীনের আধিপত্য বাড়ছে। গত বছর তারা আবার সব ধরনের গাড়ি রপ্তানিতে জাপানকে ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্টের সুবাদে স্বল্প কার্বন নিঃসরণকারী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগের প্রবাহ বাড়তে পারে। এসব কারণে সৌদি আরবের পক্ষে এখন গাড়ির বাজারে প্রতিযোগিতা করা কঠিন হয়ে যাবে বলেই বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।

রয়টার্সের সংবাদে বলা হয়েছে, সৌদি আরবের সমস্যা মূলত অভ্যন্তরীণ। গাড়িশিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় যে সহযোগী শিল্প প্রয়োজন, যেমন গাড়ির দরজা থেকে ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ, সেই সরবরাহব্যবস্থা সৌদি আরবে এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। সিয়ার সৌদি আরবের নিজস্ব বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্র্যান্ড, যেটি পিআইএফ ও তাইওয়ানের ফক্সকন কোম্পানির একটি যৌথ উদ্যোগ। তারা আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে নিজস্ব গাড়ি বাজারে নিয়ে আসতে চাইছে, যদিও এখন পর্যন্ত তারা কারখানা তৈরি করতে পারেনি।

সিয়ারের অভ্যন্তরীণ একটি সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, আগামী ২০২৬ সালের আগে এই কোম্পানি নিজস্ব ব্র্যান্ডের গাড়ি বাজারে আনতে পারবে বলে মনে হয় না। বিশ্লেষকেরাও এই কোম্পানির প্রাথমিক সফলতার সম্পর্কে সন্দিহান।

সৌদি আরবের সরকারি কর্মকর্তারা গত বছর বলেছিলেন, বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনে মধ্যপ্রাচ্যের কেন্দ্র হতে চায় দেশটি, কিন্তু তা অর্জন করতে লিথিয়ামের মতো কাঁচামালের জোগান লাগবে। সৌদি আরবের শিল্প ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সহকারী মন্ত্রী খালিদ বিন সালেহ আল মুদাইফার রয়টার্সকে বলেছিলেন, তাঁরা লিথিয়াম উৎপাদন করতে চান, যদিও এর জন্য বিনিয়োগের ঘোষণা দেওয়া হয়নি।

পিআইএফের বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত খনি কোম্পানি মাদেনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রবার্ট উইল্ট বলেছেন, লবণাক্ত পানি থেকে লিথিয়াম সংগ্রহের একটি পাইলট প্রকল্প চলছে। সময় মতো তা হয়তো পাওয়া যাবে না, কারণ কারখানা এখনো তৈরি হচ্ছে। সে জন্য প্রয়োজনে বাইরে থেকে লিথিয়াম সংগ্রহ করতে হবে।

এ ছাড়া পিআইএফ চলতি মাসে মাদানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে মানারা মিনারেলস নামে আরেকটি কোম্পানি গঠন করেছে, যাদের লক্ষ্য হচ্ছে বাইরে থেকে খনিজ পদার্থ সংগ্রহ করা।

তবে আন্তর্জাতিক গাড়িশিল্পবিষয়ক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, যত বাধাই আসুক না কেন, তা কাটিয়ে ওঠার মতো আর্থিক সক্ষমতা সৌদি আরবের আছে। অর্থ দিয়ে প্রায় সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মানুষ যা ভাবছে, তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ প্রয়োজন হবে।