ভারতের ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আদানি গ্রুপ আফ্রিকার দেশ কেনিয়ায় একটি বিমানবন্দর পরিচালনার দায়িত্ব নিতে চাইলেও তা তারা পাচ্ছে না। স্থানীয় আদালতের সিদ্ধান্তের কারণে এ–সংক্রান্ত চুক্তি হবে না।
টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, আদানি এয়ারপোর্ট হোল্ডিংস লিমিটেড সম্প্রতি ১৮৫ কোটি ডলারের বিনিময়ে নাইরোবির জোমো কেনিয়াত্তা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট (জেকেআইএ) পরিচালনার প্রস্তাব দিয়েছিল কেনিয়া সরকারকে। কিন্তু এ নিয়ে নানা আপত্তি ওঠার পর আদালত পরবর্তী আদেশ না আসা পর্যন্ত ৩০ বছর মেয়াদি এ চুক্তি না করার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
আদানিকে বিমানবন্দর ইজারা দেওয়া নিয়ে কেনিয়া সরকারের বিরুদ্ধে আইনি চ্যালেঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে এ রায় দেন আদালত। আইনজীবীদের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কেনিয়ার মানবাধিকার কমিশন এই মামলা করে। মামলার আবেদনে তারা বলে, বিমানবন্দর ইজারা দেওয়ার পদক্ষেপ অসাংবিধানিক।
আবেদনে বলা হয়, কৌশলগত ও লাভজনক জেকেআইএ কোনো বেসরকারি কোম্পানিকে ইজারা দেওয়া অযৌক্তিক। এ ধরনের পদক্ষেপ সুশাসন, জবাবদিহি, স্বচ্ছতা ও জনগণের অর্থের বিচক্ষণ ও দায়িত্বশীল ব্যবহার সম্পর্কিত সাংবিধানিক নীতিমালার লঙ্ঘন।
নাইরোবিতে জোমো কেনিয়াত্তা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অধিগ্রহণ করতে আদানি গোষ্ঠী সেখানে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি খুলেছিল। এর পরেই দেশটির বিমান পরিচালনা কর্মীদের উদ্বেগ বাড়ে। আদানি গোষ্ঠীর হাতে এই বিমানবন্দর পরিচালনার দায়িত্ব গেলে কর্মী ছাঁটাই হতে পারে, এই আশঙ্কায় ধর্মঘটের ডাক দেয় ইউনিয়ন। এমনিতেই তাঁরা চাকরির নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন। তার ওপর এখন আদানি গোষ্ঠীর হাতে বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণভার গেলে তা হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো, এই ছিল তাঁদের শঙ্কা।
এই পরিস্থিতিতে ভারতের বিরোধী দল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশ বলেছিলেন, এই ঘটনা কেনিয়ায় ভারতের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে ইন্ধন দিতে পারে। তিনি নিজের এক্স হ্যান্ডলে লিখেছিলেন, আদানিদের বিরুদ্ধে কেনিয়ার মানুষের এই আন্দোলন ভারত ও ভারতের সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষে পরিণত হতে পারে, এমন আশঙ্কা আছে।
মামলার আবেদনে আরও বলা হয়েছে, দীর্ঘ মেয়াদে ইজারা না দিয়ে অন্য কোনো উপায়ে জেকেআইএ সম্প্রসারণে প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ করতে পারে কেনিয়া সরকার। এর আগে কেনিয়া বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেনরি ওগোয়ে আইনি প্রক্রিয়া ও বিধি মেনে এই বিমানবন্দর ইজারা দেওয়ার কথা বলেছিলেন। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব আইন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ এবং প্রযুক্তিগত, আর্থিক ও আইনি পর্যালোচনার মাধ্যমে আদানিদের প্রস্তাব বিবেচনা করা হবে, এই ছিল তাঁর ভাষ্য।
কেনিয়ার এই বিমানবন্দর পরিচালনাসহ আরও কিছু প্রস্তাব দিয়েছিল ভারতের আদানি গোষ্ঠী। ত্রিশ বছর মেয়াদে বিমানবন্দর পরিচালনা করতে চেয়েছিল তারা। চলতি বছরের শুরুতে তারা এসব প্রস্তাব দেয়। এর মধ্যে ছিল বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণ, ট্যাক্সিওয়ে সংস্কার ও দুটি নতুন দ্রুতগতির ট্যাক্সিওয়ে নির্মাণ। এসব প্রকল্প ২০২৯ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার প্রস্তাব দিয়েছিল গোষ্ঠীটি। সেই সঙ্গে আরও কিছু কাজের জন্য আদানি আরও ৯ কোটি ২০ লাখ ডলারের প্রকল্প প্রস্তাব দেয়।
দ্য ইস্ট এশিয়ানে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছে, আদানি গোষ্ঠী একই সঙ্গে নাইরোবি শহরে ব্যবসাকেন্দ্র ও হোটেল-মোটেল নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল। ত্রিশ বছর বিমানবন্দর পরিচালনার পর আদানি গোষ্ঠী কর্তৃপক্ষের কাছে এটি বুঝিয়ে দেবে, এই ছিল প্রস্তাব। উভয় পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে যে মূল্য নির্ধারিত হবে, তার বিনিময়ে এই বিমানবন্দর বুঝিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেয় আদানি গোষ্ঠী।
এখন ভারতে মোট আটটি বিমানবন্দর পরিচালনা করছে আদানি গোষ্ঠী। আরও ২৫টি বিমানবন্দর পরিচালনা করতে চায় তারা। সব মিলিয়ে ভারতের ২৩ শতাংশ বিমানযাত্রীকে পরিষেবা দেয় তারা। আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড তানজানিয়া, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশে বন্দর পরিচালনার পরিকল্পনা করছে।
২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের শর্ট সেলার হিনডেনবার্গ রিসার্চ আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শেয়ার জালিয়াতির অভিযোগ তোলে। এরপর আদানি গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দামে ধস নামে। প্রতিবেদন প্রকাশের আগে বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তালিকায় আদানির অবস্থান ছিল পাঁচের মধ্যে। একপর্যায়ে তাঁর অবস্থান ২০-এর ঘরে নেমে যায়।
এরপর আদানি অনেকটা ঘুরে দাঁড়ালেও বিতর্ক তাঁর পিছু ছাড়ছে না। ভারতের বিরোধী দলগুলো বরাবরই নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর সখ্যের সমালোচনা করেন। এবার কেনিয়ায় বিমানবন্দর পরিচালনার দায়িত্বভার না পাওয়া আদানি গোষ্ঠীর জন্য আরেকটি ধাক্কা হিসেবেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।