ভারত সরকার নতুন নতুন ট্রেন কিনতে অনেক বিনিয়োগ করলেও বিদ্যমান রেললাইনের সংস্কারে অতটা মনোযোগী নয়। ওডিশায় সংঘটিত ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি আবারও নজরে এসেছে। এই দুর্ঘটনায় অন্তত ২৭৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন ১ হাজার ১০০ জনের বেশি। রেলের সিগন্যালিং দুর্বলতার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে এমন নয় যে ভারত সরকার রেলের উন্নয়নে বিনিয়োগ করছে না। গত অর্থবছরে দেশটির সরকার ৩০ বিলিয়ন বা ৩ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক দুর্ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে নিরাপত্তাব্যবস্থায় আরও বিনিয়োগ করতে হবে।
নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদে বলা হয়েছে, নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে ভারতে রেলব্যবস্থায় অনেক বিনিয়োগ হয়েছে, কিন্তু রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তাব্যবস্থায় বিশেষ বিনিয়োগ করা হচ্ছে না। বরং নরেন্দ্র মোদির লক্ষ্য হচ্ছে, রেলের গতি, আরাম-আয়েশ বাড়ানো বা বুলেট ট্রেন ও উচ্চ ভাড়ার ট্রেন নামানো।
ভারত সরকার মনে করছে, এসব করে ভারতের রেল সেবাকে বিশ্বমানে নিয়ে যাওয়া যাবে এবং তাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা সম্ভব হবে। কিন্তু সমালোচকেরা বলছেন, এসব উদ্যোগ রেলের নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে কাজে আসছে না।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতের ১৩ হাজার পুরোনো ট্রেনের নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নতিতে বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে। দেশটির সবশেষ বাজেটেও দেখা গেছে, রেলের নিরাপত্তায় বরাদ্দ মোট বাজেটের অনুপাত ও টাকার অঙ্ক—উভয় দিক থেকেই কমেছে।
নয়াদিল্লিভিত্তিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের জ্যেষ্ঠ ফেলো পার্থ মুখোপাধ্যায় বিশেষ এক চাহিদার কথা তুলে ধরেন নিউইয়র্ক টাইমসের কাছে। তিনি বলেন, সিগন্যালিংয়ে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। কৌশলগতভাবে সিগন্যালিং খুব উচ্চ সক্ষমতার বিষয় নয়, কিন্তু ভারত যতই উচ্চ গতিসম্পন্ন ট্রেন চালু করবে, তত বেশি তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
তবে নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদে বলা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে ভারতে রেল পরিবহন এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ হয়েছে। ১৯৮০-এর দশক থেকে ২০০০-এর শুরুতে প্রতিবছর গড়ে ৪৭৫টি রেল লাইনচ্যুত হতো। ২০২১ সালের আগের দশকে তা নেমে এসেছে ৫০-এ। ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অন ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টে জমা দেওয়া ভারতীয় রেলের প্রতিবেদনের সূত্রে এই তথ্য উল্লেখ করেছে নিউইয়র্ক টাইমস।
এ ছাড়া সামগ্রিকভাবে ভারতের রেলের নিরাপত্তাব্যবস্থাও উন্নত হয়েছে। ২০০০-এর শুরুর দিকে বছরে গড়ে ৩০০টি গুরুতর দুর্ঘটনা হতো, ২০২০ সালে তা ২২-এ নেমে এসেছে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত ভারতে প্রতিবছর গড়ে ১০০ মানুষ রেল দুর্ঘটনায় মারা যেত; ২০১৮ ও ২০১৯ সালে পরপর ২ বছর তা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে।
নরেন্দ্র মোদির সরকার ব্যয় বাড়াচ্ছে। দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিশ্বব্যাংক আশা করছে, বেসরকারি কোম্পানিগুলো আরও অর্থ বিনিয়োগ করবে। এপ্রিলে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যে ভারত সরকারের ব্যয় প্রাক্-মহামারি সময়ের তুলনায় অনেকটা বেড়েছে। রেলওয়েসহ যোগাযোগ খাতে বড় বিনিয়োগ হচ্ছে।
রেলের নিরাপত্তাব্যবস্থার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সবচেয়ে বড় উদ্ভাবন হচ্ছে ‘কবচ’ নামের নতুন এক ব্যবস্থা চালু করা। এর প্রদর্শনীতে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব ও রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান অংশ নিয়েছিলেন। বিষয়টি হলো, দুটি ট্রেন একই লাইনে পরস্পরের দিকে এগিয়ে গেলে যদি তারা পরস্পরের ৪০০ মিটারের মধ্যে চলে আসে, তাহলে নতুন ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্রেক চেপে দেবে।
কিন্তু সব ট্রেনে এখনো এই ব্যবস্থা চালু হয়নি, ৪০ হাজার মাইল রেলওয়ের মধ্যে মাত্র ৯০০ মাইল রুটে এটি চালু হয়েছে। করমন্ডল এক্সপ্রেসে এই ব্যবস্থা ছিল না।
ভারতের সাবেক রেলমন্ত্রী ও বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিকদের বলেছেন, এই ব্যবস্থা করমন্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনে থাকলে পরিস্থিতি এমন হতো না।
এই ঘটনার পর রেলমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি উঠেছে। কিন্তু তিনি তা নাকচ করে বলেন, এই দুর্ঘটনা নিছক সংঘর্ষ-নিরোধক ব্যবস্থার বিষয় ছিল না।