চীনের হাতে থাকা মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের পরিমাণ গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে বলে বুধবারে প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার বৃদ্ধি এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই দুই অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যে ক্রমান্বয়ে উত্তেজনা বেড়ে চলার প্রেক্ষাপটে চীন বন্ড ধরে রাখা কমিয়ে দিয়েছে।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জানুয়ারিতে চীনের হাতে থাকা ট্রেজারি বন্ডের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৮৫ হাজার ৯৪০ কোটি ডলারে। গত ছয় মাস ধরেই এটি কমছে এবং ২০০৯ সালের মে মাসের পর এটিই সর্বনিম্ন। মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রকাশ করা পরিসংখ্যানে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
শুধু জানুয়ারি মাসেই চীন তাদের কাছে থাকা ৭৭০ কোটি ডলারের ট্রেজারি বন্ড কমিয়েছে। ডিসেম্বরে কমানো হয়েছিল ৩১০ কোটি ডলার এবং নভেম্বরে ৭৮০ কোটি ডলার মূল্যের বন্ড।
দীর্ঘদিন ধরেই চীন তাদের বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের একটি বড় অংশই মার্কিন ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করে আসছে। তবে এখন মনে করা হচ্ছে যে দেশটি তাদের বিনিয়োগ বহুমুখী করা এবং মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছে।
এ ছাড়া চীন তাদের আন্তর্জাতিক লেনদেনে নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ানের আরও বেশি ব্যবহার এবং ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়া যে ধরনের নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হয়েছে, সেই ধরনের নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকতে চাইছে বলেও অনেকে মনে করছেন।
ওয়াশিংটনের আর্থিক নীতি নিয়ে বেইজিংয়ের যে অস্বস্তি রয়েছে, ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ কমিয়ে দেওয়াকে তারও একটি নিদর্শন হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১ ফেব্রুয়ারি সুদের হার ১ শতাংশের এক–চতুর্থাংশ বাড়িয়েছে। চীন তার আগেই বন্ডে বিনিয়োগ কমিয়েছে। নীতি সুদের হার বাড়ায় ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। স্থানীয় মুদ্রাকে সমর্থন দিতে এবং পুঁজি বেরিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে আর্থিক বাজারকে স্থিতিশীল করতে নানা দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ট্রেজারি বন্ড বিক্রি করে।
সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের পতন এবং মার্কিন আর্থিক ব্যবস্থায় ঝুঁকি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ আপাতত আর সুদের হার বাড়াবে না, এমনটাই আশা করছেন বেশির ভাগ বিশ্লেষক।
চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভূরাজনৈতিক রেষারেষি বেড়েই চলেছে। তবে জানুয়ারির মাঝামাঝি সুইজারল্যান্ডে মার্কিন অর্থমন্ত্রী জেনেট ইয়েলেন এবং চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী লিউ হের মধ্যকার বৈঠক এমন ইঙ্গিতও দিচ্ছে যে দুই দেশ সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
ফেব্রুয়ারিতে এসে আবার দুই দেশের সম্পর্ক খারাপের দিকে মোড় নেয়। এর প্রধান কারণ ছিল বেলুনের ঘটনা। এ ছাড়া রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে দুই দেশের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান এবং কোভিড–১৯ কোথা থেকে এসেছে—এসব নিয়েও দুই দেশের আলাদা অবস্থান রয়েছে।
২০২১ সাল থেকেই অবশ্য মার্কিন ট্রেজারি বন্ড হাতে রাখার পরিমাণ কমাচ্ছিল চীন। পরের বছরের মে মাসে বন্ডের পরিমাণ এক লাখ কোটি ডলারের নিচে নেমে আসে। এর আগের ১২ বছরের মধ্যে এমন ঘটনা আর ঘটেনি।
কিছু বিশ্লেষক সে সময় বলেছিলেন যে সম্ভবত বেইজিং তখন ওয়াশিংটনের সঙ্গে ‘একটি সম্ভাব্য সংঘাত’ এড়ানোর চেষ্টা করছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং গত সপ্তাহে এমন অভিযোগ করেন যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব চীনের উন্নয়নকে দমন করার চেষ্টা করছে। তাঁর সুরে সুর মিলিয়ে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই প্রথমবারের মতো বলেছে যে এই চেষ্টাকে তারা প্রতিহত করবে।
চীন যখন হাতে রাখা মার্কিন বন্ড কমাচ্ছে, তখন জাপান জানুয়ারি মাসে বন্ডের পরিমাণ বাড়িয়েছে। এই সময়ে তারা ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের নতুন বন্ড কিনেছে, ফলে তাদের হাতে থাকা বন্ডের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ কোটি ডলারের বেশি।
যে ১০টি দেশের হাতে সবচেয়ে বেশি মার্কিন বন্ড রয়েছে, তাদের মধ্যে চারটি দেশ জানুয়ারি মাসে তার আগের মাসের তুলনায় বন্ডের পরিমাণ কমিয়েছে।
যেসব বিদেশি সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ট্রেজারি বন্ড কেনে, চীন তাদের মধ্যে অন্যতম। ২০১৯ সালে এ ক্ষেত্রে জাপান ছিল শীর্ষে। চীন দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল এবং তারা আন্তর্জাতিক বন্ড বাজারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।