বিপুল অর্থ নিয়ে সমস্যায় পড়েছে ফিলিস্তিনি পশ্চিম তীরের ব্যাংকগুলো

বিশ্বের অধিকাংশ ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল সমস্যা অর্থায়নের সংকট। কিন্তু অধিকৃত পশ্চিম তীরের ব্যাংকগুলোর সমস্যা ঠিক তার উল্টো। সেটা হলো, তাদের কাছে এত নগদ অর্থ এখন অনেক বেশি। 

গাজায় ইসরায়েলের হামলার পর এমনিতেই ফিলিস্তিনের অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে পড়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পশ্চিম তীরের ব্যাংকগুলোর হাতে জমা হওয়া ৪২০ কোটি ডলারের বেশি উদ্বৃত্ত তারল্য। এই পরিস্থিতিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি চুরি-ডাকাতির আশঙ্কাও বাড়ছে বলে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সংবাদে বলা হয়েছে।

ফিলিস্তিনের ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, এটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি বছরের মধ্যে এই অলস অর্থের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এটা পশ্চিম তীরের জিডিপির ১৫ শতাংশের বেশি। এই পরিস্থিতি একদিকে ব্যাংকের জন্য সমস্যা, অন্যদিকে ফিলিস্তিনের যে ব্যবসায়ীরা ইসরায়েলের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন, তাঁদের জন্যও বড় সমস্যা।

এই অতিরিক্ত তারল্যের মূল কারণ হচ্ছে ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা। পশ্চিম তীরের ব্যাংকগুলো ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কী পরিমাণ অর্থ স্থানান্তর করতে পারবে, তার একটা সীমা আছে। সেই ১৯৯০-এর দশকের স্বাক্ষরিত এক চুক্তি অনুযায়ী, পশ্চিম তীরের ব্যাংকগুলো ইসরায়েলের মুদ্রা শেকেল ব্যবহার করে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার আগে পশ্চিম তীরের ব্যাংকগুলোর হাতে শেকেলের মূল উৎস ছিল সেই ফিলিস্তিনি নাগরিকেরা, যাঁরা ইসরায়েলে কাজ করতেন এবং নগদে বেতন পেতেন। ইসরায়েলে কাজ করে তাঁরা পশ্চিম তীরে প্রতিবছর প্রায় ২০ বিলিয়ন বা ২ হাজার কোটি শেকেল নিয়ে আসতেন। এ ছাড়া ইসরায়েলে বসবাসরত ফিলিস্তিনি নাগরিকেরা যাঁরা পশ্চিম তীরে কেনাকাটা করতে আসতেন, তাঁরাও সেখানে বছরে ৬০০ থেকে ৭০০ কোটি শেকেল ব্যয় করতেন।

কিন্তু সমস্যা হলো, ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পশ্চিম তীরের ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে বছরে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮০০ কোটি শেকেল জমা নেয়। ফলে প্রতিবছরই পশ্চিম তীরের ব্যাংকগুলোর হাতে অতিরিক্ত শেকেল জমা হয়।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এর আগেও বলেছে, এটা যথেষ্ট নয়। যে পরিমাণ শেকেল ফিলিস্তিনের ব্যাংকে জমা হয়, তার সঙ্গে এটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ২০২২ সালের এক হিসাবে তারা বলেছে, অতিরিক্ত শেকেল ধরে রাখার কারণে ফিলিস্তিনের ব্যাংকগুলোর মুনাফা বছরে ২০ শতাংশ কমে যায়। ফিলিস্তিনের এক ব্যাংকারের তথ্যানুসারে, ২০১২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তাঁদের ক্ষতি হয়েছে অন্তত ৫০ কোটি ডলার।

সেই ব্যাংকারের ভাষ্য, এই অর্থ ঋণ দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ, ফিলিস্তিনের ব্যাংকগুলো নগদ অর্থ ঋণ দেয় না। অথচ এই অর্থ অর্থনীতিতে সঞ্চালিত হলে মূল্য সৃষ্টি হতো।

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ফিলিস্তিনি নাগরিকেরা এখন ইসরায়েলে কাজ করতে যেতে পারেন না। যুদ্ধের কারণে মানুষের ব্যয় অনেক কমে যাওয়ায় অর্থ জমা হচ্ছে এবং তাঁরা অনিশ্চয়তার কারণে বাড়িতে না রেখে সেই অর্থ ব্যাংকে জমা রাখছেন। যুদ্ধের কারণে একধরনের ছায়া অর্থনীতি তৈরি হচ্ছে, যেখানে মূলত নগদ অর্থে লেনদেন হয়। এসব কারণে পশ্চিম তীরের ব্যাংকগুলোর হাতে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ জমা হয়েছে।

গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রামাল্লাহর অর্থনৈতিক বাস্তবতা নির্মম রূপ নিয়েছে। সুপারমার্কেটগুলো থেকে পণ্য চুরি ঠেকাতে নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। হাজার হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানকার সরকারি কর্মকর্তারাই বলছেন, বর্তমানে সেখানে যে অর্থনৈতিক সংকট শুরু হয়েছে, তা করোনার লকডাউনের চেয়ে গুরুতর।

এই পরিস্থিতিতে পশ্চিম তীরের ব্যাংকগুলোয় সশস্ত্র ডাকাতি বেড়ে গেছে। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত এক ব্যক্তি ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, গত বছর এই অঞ্চলের ব্যাংকগুলোয় অন্তত আটটি সশস্ত্র ডাকাতি হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। চলতি বছর এখন পর্যন্ত তিনটি ডাকাতি হয়েছে। যদিও অন্য কর্মকর্তারা বলছেন, এ সংখ্যাটা আরও বেশি হবে।

কিন্তু এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, বিশেষ করে ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ যেমন অতি জাতীয়তাবাদী অবস্থান নিয়েছেন, তাতে ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে বিশেষ সহায়তা করবে না বলেই ধারণা করা যাচ্ছে। ইসরায়েল সরকার ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হয়ে রাজস্ব সংগ্রহ করত, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সেই অর্থ স্থানান্তরেও সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছেন ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী। এ ছাড়া ইসরায়েলের ব্যাংকগুলো ফিলিস্তিনের ব্যাংকগুলোকে যে ব্যাংকিং সহায়তা দিত, তা–ও বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন তিনি।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সেটা হলে পশ্চিম তীরের অর্থনীতি আরও বিপদে পড়বে। অতিরিক্ত তারল্যের চেয়ে এটি আরও বড় বিপদ বয়ে আনবে।