জরিপের প্রতিবেদন

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা বড় ঝুঁকি বলে মনে করছেন ঝুঁকি কর্মকর্তারা

বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছেন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি কর্মকর্তারা। এই দেশগুলোর ভেতরেও অস্থিরতা থাকবে বলে করছেন তাঁরা। সিংহভাগ ঝুঁকি কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, বৈশ্বিক পরিসরে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এই জরিপে অংশ নেওয়া ৮৫ শতাংশেরও ঝুঁকি কর্মকর্তা এমনটা মনে করছেন। বছরের মাঝামাঝি সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের ঝুঁকি নির্ণয়ে এই জরিপ করেছে সংস্থাটি।

এই জরিপে মূলত পাঁচটি বিষয়ে ঝুঁকি কর্মকর্তাদের মনোভাব যাচাই করা হয়েছে। সেই পাঁচটি বিষয় হলো ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক, দেশীয় রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও প্রযুক্তি। আগামী ছয় মাস বৈশ্বিক অস্থিরতা কেমন থাকবে, তা পরিমাপে জরিপ করা হয়। সংঘাত, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকে শুরু করে নীতি পরিবর্তন, সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্ন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো বিষয়ের বিকাশ নিয়েও উদ্বিগ্ন বলে জানিয়েছে প্রধান ঝুঁকি কর্মকর্তারা।

এই জরিপে ঝুঁকি কর্মকর্তাদের ঝুঁকির পাঁচটি মূল জায়গা চিহ্নিত করতে আহ্বান জানানো হয়, আগামী ছয় মাসে ব্যবসা-বাণিজ্যে যেগুলোর বড় প্রভাব পড়তে পারে।

তবে তাঁরা চারটি খাত চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হলো সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচক; মূল্য নির্ধারণ ও উৎপাদনের প্রধান উপকরণের সরবরাহে বিঘ্ন; সশস্ত্র সংঘর্ষ ও অস্ত্রের ব্যবহার; নিয়ন্ত্রক সংস্থার নীতি পরিবর্তন, নিয়ম মান্য করানো, পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এ ছাড়া তাঁরা বড় অর্থনীতির দেশগুলোর ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়েও বেশ চিন্তিত।

গত জুন মাসে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ছিল, ২০২৩ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি হবে ২ দশমিক ১ শতাংশ; ২০২২ সালে যা ছিল ৩ দশমিক ১ শতাংশ। অন্যান্য বৈশ্বিক সংস্থাও একই ধরনের পূর্বাভাস দিচ্ছে। এর প্রধান কারণ নীতি সুদহার বৃদ্ধি; ইউরোপে যা গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং আমেরিকায় ২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সে কারণে চাহিদায় প্রভাব পড়ছে, কমছে প্রবৃদ্ধির গতি।

এই নীতি সুদহার বাড়ার ফলে গ্রাহকদের চাহিদা কমলেও ঋণের সুদ বেড়ে গেছে। প্রায় এক–চতুর্থাংশ ঝুঁকি কর্মকর্তা বলেছেন, নীতি সুদহার বৃদ্ধি এই বছর তাঁদের কোম্পানিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। এর মধ্যেও ভালো খবর হলো, খুব কমসংখ্যক কর্মকর্তাই বেকারত্ব সমস্যাকে ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন; বেশির ভাগ ওইসিডি অন্তর্ভুক্ত দেশের শ্রমবাজারের সূচক রেকর্ড উচ্চতায় অবস্থান করছে।

প্রধান ঝুঁকি কর্মকর্তারা আরও বলছেন, বেশির ভাগ দেশে ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। এতে পণ্য সরবরাহে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন তাঁরা। বেশির ভাগ কর্মকর্তাই মনে করছেন, জ্বালানির মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের সরবরাহ প্রয়োজনের তুলনায় কম; সে কারণেও আগামী মাসগুলোতে তাদের কোম্পানিতে বড় প্রভাব পড়তে পারে।

বেশির ভাগ বড় অর্থনীতির দেশে খাদ্যের দাম ঐতিহাসিকভাবে এখন বেশি। এ ছাড়া আবহাওয়ার এল নিনো প্রভাবের কারণে বেশ কিছু দেশে ফসল উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটতে পারে এবং পানির ঘাটতি দেখা যেতে পারে।

বিশ্বে এখনো শতাধিক সশস্ত্র সংঘাত ঘটছে। ফলে অনেক কোম্পানি সরাসরি প্রভাবিত হয়েছে, আবার অন্যরা বাণিজ্য ও সরবরাহে পরোক্ষ বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।
১৮ মাস ধরে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। সেই সঙ্গে সম্প্রতি রাশিয়া শস্যচুক্তি থেকে বেরিয়ে গেছে; এ বিষয়কেও হুমকি হিসেবে দেখছেন কর্মকর্তারা। রাশিয়ার এ সিদ্ধান্তে বিশ্বব্যাপী খাদ্যনিরাপত্তা আরও হুমকির মুখে পাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

একজন ঝুঁকি কর্মকর্তা বলেছেন, যুদ্ধ শুধু একটি দেশের জন্য শুধু ক্ষতিকর নয়; বরং এ কারণে বিশ্বব্যাপী দেশগুলোর পারস্পরিক নির্ভরশীলতায় বড় প্রভাব পড়ছে। এক-চতুর্থাংশ কর্মকর্তা পূর্বাভাস দিয়েছেন, শুধু দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষ নয়, ধর্মঘট, দাঙ্গাসহ আন্তরাজ্য সহিংসতার কারণে আগামী ছয় মাসে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো চাপের মুখে পড়বে।

জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন এবং শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের কারণেও সামগ্রিক অস্থিরতায় প্রভাব পড়বে। এ ছাড়া নতুন করে বিভিন্ন নীতি পরিবর্তন এবং প্রয়োগও ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন বেশির ভাগ কর্মকর্তা।

বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আইনসহ জলবায়ু পরিবর্তন ও এআই প্রযুক্তি সম্পর্কিত নীতি পরিবর্তনও অর্থনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করবে বলে মনে করছেন ঝুঁকি কর্মকর্তারা। প্রায় ৭৫ শতাংশ কর্মকর্তা সহমত প্রকাশ করেছেন যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তাদের প্রতিষ্ঠানের সুনামের ক্ষতি করবে।

এ ছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যক্তিগত তথ্য রক্ষায় নিরাপদ নয় বলে জানিয়েছেন অনেক কর্মকর্তা। নিজ নিজ কোম্পানিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের বিষয়ে অর্ধেকের বেশি কর্মকর্তা বলেছেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তাঁরা অ্যালগরিদম ব্যবহারের নিরাপত্তা, বৈধতা ও নৈতিক দিকগুলো পর্যালোচনা করবে। একজন প্রধান ঝুঁকি কর্মকর্তা মন্তব্য করেছেন যে তাঁরা এআইকে ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন না, বরং কোম্পানির বেশির ভাগ মানুষ এই প্রযুক্তিকে খুব একটা সমর্থন করছেন না। সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো, এই প্রযুক্তির পরিবর্তনের গতি এবং এর প্রভাব কী হবে, সে বিষয়ক ধারণার অভাব।

এই বাস্তবতায় কোম্পানিগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা করতে হবে বলে মনে করেন জুরিখ ইন্স্যুরেন্স গ্রুপের প্রধান ঝুঁকি কর্মকর্তা পিটার জিগার। তিনি মনে করেন, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির মতো সাময়িক সংকট নিয়ে বেশি মাথা ঘামানো হলে ভবিষ্যতের বড় ঝুঁকির বিষয়গুলো চোখ এড়িয়ে যেতে পারে।

এ ক্ষেত্রে এআইয়ের উদাহরণ দিয়েছেন পিটার। এআই সবার জীবন ব্যাহত করবে না বলেই মনে করেন পিটার। তবে ভবিষ্যতে এটি কী পরিবর্তন নিয়ে আসবে বা তার প্রভাব কী হবে, তা খতিয়ে দেখা না হলে বড় ধরনের ভুল হয়ে যাবে বলে মনে করছেন তিনি।