গৌতম আদানি
গৌতম আদানি

গৌতম আদানি কে, ভারতীয় এই ব্যবসায়ীকে নিয়ে এত বিতর্ক কেন

ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে সরকারি কাজ পেতে তিনি ঘুষ দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আনা অভিযোগে বলা হয়েছে, ২৬ কোটি ৫০ লাখ ডলারের ঘুষ কেলেঙ্কারির সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। তাঁকে নিয়ে অবশ্য বিতর্ক এই প্রথম নয়; বরং তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে একের পর এক বিতর্ক উঠেছে নিজের দেশ ভারত, এমনকি বিদেশেও।

গৌতম আদানি হলেন প্রথম প্রজন্মের ব্যবসায়ী। রকেটের গতিতে তিনি ধনী হয়েছেন। ব্যবসা শুরু করার পর মাত্র কয়েক দশকে তিনি এতটাই ধনী হন যে একপর্যায়ে বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তালিকায় অবস্থান দাঁড়ায় দুইয়ে। আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম আদানি এখন এশিয়ার দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী।

রয়টার্স জানিয়েছে, ২০০৮ সালে আদানি একবার মৃত্যুর খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। সে বছর মুম্বাইয়ে তাজমহল প্যালেস হোটেলে যখন বন্দুকধারীরা হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল, তখন তিনি আরও অনেকের সঙ্গে সেখানে আটকা পড়েছিলেন।

জালিয়াতি ও ঘুষ দেওয়ার অভিযোগে এখন গৌতম আদানি যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার মুখোমুখি হয়েছেন। তাঁকে ফৌজদারি জরিমানার মধ্যেও পড়তে হতে পারে।

গত বছর মার্কিন শর্টসেলার প্রতিষ্ঠান হিনডেনবার্গ রিসার্চ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে শেয়ার জালিয়াতির অভিযোগ এনেছিল। ওই অভিযোগে আরও বলা হয়, কর ফাঁকির স্বর্গ হিসেবে পরিচিত অঞ্চল থেকে অবৈধ প্রক্রিয়ায় অর্থ এনে আদানির শেয়ারে বিনিয়োগ করা হয়েছিল। ওই অভিযোগের পর আদানির শেয়ারের দামে দ্রুত পতন হতে শুরু করে। একপর্যায়ে আদানির কোম্পানিগুলো ১৫০ বিলিয়ন বা ১৫ হাজার কোটি ডলারের বাজার মূলধন হারায়।

আর যুক্তরাষ্ট্রে ঘুষের অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার পর চলতি দফায় গত এক সপ্তাহে আদানির কোম্পানিগুলো ৫৫ বিলিয়ন বা ৫ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের বাজার মূলধন হারিয়েছে। আগেরবারের মতো এবারও সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে আদানি গ্রুপ। তবে আদানিকে নিয়ে বিতর্ক বরং আরও জোরদার হয়েছে, যা গড়িয়েছে ভারতের পার্লামেন্টেও। বৃহস্পতিবার তৃতীয় দিনের মতো সংসদে বিরোধী সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে পার্লামেন্ট অধিবেশন মুলতবি করা হয়।

আদানির উত্থান

গৌতম আদানির ব্যবসার মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ ও বন্দর থেকে শুরু করে চিনি ও সয়াবিন পর্যন্ত। তাঁর বয়স এখন ৬২ বছর। একসময় স্কুল থেকে ঝরে পড়েছিলেন তিনি, অর্থাৎ আনুষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি নিতে পারেননি তিনি। অল্প সময়ের জন্য তিনি ধনীর তালিকায় টেসলার ইলন মাস্কের পরেই ছিলেন। ফোর্বসের তথ্যানুযায়ী, তিনি এখন বিশ্বের ২৫তম ধনী ব্যক্তি, যাঁর ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ ৫ হাজার ৭৬০ কোটি ডলার।

ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গুজরাটের আহমেদাবাদে আদানির জন্ম ১৯৬২ সালের ২৪ জুন। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও একই রাজ্যের মানুষ। দশম শ্রেণির পড়াশোনা শেষ করে আদানি স্কুল ছেড়ে দিয়েছিলেন। তখন তাঁর বয়স ১৬ বছর। এরপর তিনি দেশটির বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ে চলে যান এবং একটি রত্ন ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠানে কাজ খুঁজে পান। পরে কিছুদিন কাজ করেন ভাইয়ের প্লাস্টিক ব্যবসার প্রতিষ্ঠানে।

গৌতম আদানি ১৯৮৮ সালে নিজের নামেই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে বসেন। তাঁর শুরুর ব্যবসা ছিল পণ্য রপ্তানি। একটি মধ্যম আয়ের পরিবার থেকে তিনি এসেছেন, যে পরিবারের মূল ব্যবসা ছিল কাপড়ের। ভারতের অন্যান্য শতকোটিপতিদের সঙ্গে আদানির পার্থক্য এখানেই। বেশির ভাগ ভারতীয় বিলিয়নিয়ার পারিবারিকভাবেই ধনী, অর্থাৎ তাঁরা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পেয়েছেন। গৌতম আদানি যা পাননি।

গৌতম আদানির স্ত্রী প্রীতি আদানি। তিনি একজন দাঁতের চিকিৎসক। দুই ছেলে—করণ ও জিৎ। দুজনেই পারিবারিক ব্যবসায় নাম লিখিয়েছেন। যেমনটা ভারতের অন্য সব পরিবারে ঘটে থাকে।

গৌতম আদানি যেভাবে ব্যবসা চালান, সে সম্পর্কে সরাসরি ধারণা আছে এমন একজন জানিয়েছেন, নিজের ব্যবসায়ী সাম্রাজ্য চালাতে তিনি ‘একবারে নিজস্ব ধরন’ ব্যবহার করেন। নিজের বয়স ৭০ হলে আদানি তাঁর ব্যবসা পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করবেন বলে জানান।

বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় ও বিদেশি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আদানি নিজেকে একজন লাজুক ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। নিজের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হওয়ার জন্য তিনি অংশত তাঁর ওপর যে রাজনৈতিক আক্রমণ চলে, তাকে দায়ী করেছেন। তবে প্রয়োজনমতো রাজনীতিবিদদের তিনি প্রশংসা করতেও ভোলেন না।

ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আদানি এক্স প্ল্যাটফর্মে লেখেন যে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ‘দৃঢ়চিত্তের মানুষ, যাঁকে ভাঙা যায় না, যাঁর বুকের পাটা রয়েছে, রয়েছে দৃঢ় সংকল্প ও নিজের বিশ্বাসের পক্ষে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মতো সাহস’।

ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়ে আদানি গত সপ্তাহে ঘোষণা করেন যে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি ও অবকাঠামো প্রকল্পে তাঁর ব্যবসায়ী গ্রুপ এক হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। এসব বিনিয়োগ ১৫ হাজার কর্মসংস্থান তৈরি করবে, এ তথ্য জানালেও এর বাইরে বিস্তারিত আর কিছু জানাননি তিনি। তবে সেই যুক্তরাষ্ট্রেই এখন তাঁর ও পরিবারের অন্য সদস্যসহ গ্রুপের কয়েকজন নির্বাহীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলো।

প্রশ্ন আর বিতর্ক

আদানি গ্রুপের বড় বিনিয়োগ রয়েছে জ্বালানি খাতে। তাদের কয়লা ও বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে যেসব দেশে প্রশ্ন উঠেছে, তার মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে রাজনৈতিকভাবে আক্রমণ করতে ভারতীয় বিরোধী দলগুলো নিয়মিতভাবে আদানির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে। তাদের অভিযোগ, আদানিকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। মুম্বাইয়ের একটি বিশাল বস্তি উন্নয়নের কাজ আদানিকে দেওয়ার বিষয়টি প্রায়ই সামনে চলে আসে।

গৌতম আদানি আর সরকার—উভয় পক্ষই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রে সর্বশেষ যে অভিযোগ এসেছে, সেটি আদানির জন্য বড় সমস্যা ডেকে আনতে পারে। দেশটির কর্তৃপক্ষ বলেছে, গৌতম আদানি ও অন্য সাতজন সরকারি কাজ পেতে ভারতীয় কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে রাজি ও পরে ঘুষ দিয়েছিলেন। এই কাজ পেলে আগামী ২০ বছরে তাঁদের কোম্পানি ২০০ কোটি ডলার মুনাফা করত। পাশাপাশি তাঁরা ভারতের সবচেয়ে বড় সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজও পেতে চেয়েছিলেন।

যেসব অভিযোগ এসেছে, তা নিয়ে রয়টার্স আদানি গ্রুপের মন্তব্য জানতে চাইলেও কোম্পানির পক্ষ থেকে সাড়া পায়নি।

তবে আদানি গ্রুপ এর আগে একটি বিবৃতিতে বলেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের নেওয়া পদক্ষেপের কারণে ‘উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া’ হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক প্রকল্প বাতিল, আর্থিক বাজারে প্রতিক্রিয়া এবং কৌশলগত অংশীদার, বিনিয়োগকারী ও সাধারণ মানুষের মাধ্যমে হঠাৎ নিরীক্ষা।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তার একটি এসেছে কেনিয়া থেকে। দেশটির প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো বলেছেন, কেনিয়ার বিদ্যুৎ নেটওয়ার্ক ও প্রধান বিমানবন্দর সম্প্রসারণের যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, তার সঙ্গে আর আদানি গ্রুপের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। জোমো কেনিয়াত্তা বিমানবন্দর প্রকল্পে ১৮৫ কোটি ডলার ও রাষ্ট্রমালিকানার পরিষেবা কেট্রাকোতে ৭৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা ছিল আদানি গ্রুপের।

অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা কর্তৃপক্ষ সে দেশে আদানির কিছু বিনিয়োগ নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ৪৪ কোটি ২০ লাখ ডলারের একটি বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং কলম্বোয় আদানি গ্রুপের নেতৃত্বাধীন একটি গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প। এই প্রকল্পের মোট খরচ ধরা হয়েছে ৭০ কোটি ডলারের বেশি।