যুক্তরাষ্ট্র কি ধর্মঘটের যুগে ফেরত যাচ্ছে

যুক্তরাষ্ট্র
প্রতীকী ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রে ইউনাইটেড অটো ওয়ার্কার (ইউএডব্লিউ) নামে গাড়িশ্রমিকদের একটি ইউনিয়নের ধর্মঘট শুরু হয়েছে। এই ধর্মঘট হঠাৎ করে শুরু হয়নি। এই আন্দোলন মার্কিন কর্মীদের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধির অংশ।

বর্তমানে দেশটিতে হলিউডের লেখক থেকে শুরু করে নার্স, কারখানার কর্মী, স্টারবাকসের কর্মী ও নানা পেশার হাজারো শ্রমিক বেতন বৃদ্ধিসহ কাজের পরিবেশের উন্নতি ও সুবিধা বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘট করছেন। সম্প্রতি শ্রমিকদের সংগঠন টিমস্টার ইউনিয়ন ইউনাইটেড পার্সেল সার্ভিস বা ইউপিএসের কর্মীদের বেতন বৃদ্ধি ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভ্যানের দাবিতে ধর্মঘট করার হুমকি দিয়েছে। এই ধর্মঘটে ৩ লাখ ৪০ হাজার ইউপিএস কর্মী অংশগ্রহণ করবে বলে জানিয়েছে ইউনিয়নটি।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। গত কয়েক দশকে দেশটির ধনী মানুষের ধনসম্পদ বাড়লেও নিম্ন ও মধ্যম আয়ের শ্রমিকদের মজুরি তেমন একটা বাড়েনি। করোনাভাইরাস মহামারিতে করপোরেট কোম্পানিগুলো বিপুল মুনাফা করেছে। এর পর থেকে কর্মীরাও চাইছেন, তাঁদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হোক।

জর্জ টাউন ইউনিভার্সিটির শ্রম ইতিহাসবিদ জোসেফ ম্যাককার্টিন সিএনএনকে বলেন, শ্রমিকদের আন্দোলন ও চিন্তাধারায় প্রজন্মগত পরিবর্তন ঘটছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইকোনমিক পলিসি ইনস্টিটিউটের তথ্যানুসারে, ১৯৭৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সে দেশের শীর্ষ ১ শতাংশ কর্মীর মজুরি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয়ের পর ১৪৫ শতাংশ বেড়েছে, যেখানে বাকি ৯০ শতাংশ কর্মীর গড় বার্ষিক মজুরি বেড়েছে মাত্র ১৬ শতাংশ। বিভিন্ন কারণেই এই বৈষম্য হয়েছে, যেমন আইনকানুন শিথিল হওয়া, শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর পতন ও ফেডারেল মজুরি নীতিতে যথেষ্ট পরিবর্তন না আসা।

ফোর্ড, জেনারেল মোটরস ও স্টেলান্টিসনের মতো কোম্পানিগুলোর প্রধান নির্বাহীদের বেতন গত চার বছরে ৪০ শতাংশ বেড়েছে—এই বিষয়টিকে সামনে এনে গাড়িশ্রমিকেরা মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন করছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজারে এখন শ্রমিকদের চাহিদা বেশি, ইউনিয়নগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থনও গত কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। এই অবস্থায় শ্রমিকেরা মনে করছেন, এখন তাঁদের দর-কষাকষির সক্ষমতাও বেশি।

জোসেফ ম্যাককার্টিন বলেন, শ্রমবাজার এখন শক্তিশালী, অর্থনীতিও ভালো অবস্থানে আছে। এই পরিস্থিতিতে শ্রমিক ও ইউনিয়নগুলো মনে করছে, দর-কষাকষি করার মতো অস্ত্র তাদের হাতে আছে, অর্থনীতির শক্তিগুলোও তাদের অনুকূলে। বিশেষ করে মহামারির পর যেভাবে সে দেশের মানুষ চাকরি ছাড়ছেন, তাতে কোম্পানিগুলোও লোকবল–সংকটে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে।

করোনাভাইরাস মহামারি নিয়োগকর্তা ও চাকরিপ্রার্থী—উভয়কেই কাজের পরিবেশ নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, কলেজ পাস করা কর্মীরা আর্থিক নিরাপত্তার চেয়ে নিজেদের আবেগকে বেশি গুরুত্ব দেন। তাই কোম্পানিগুলোও নিয়োগের ক্ষেত্রে এখন কর্মীদের আরও কী কী সুযোগ দেওয়া যায়, তা নতুনভাবে মূল্যায়ন করছে।

কোভিড মহামারির সময় সম্মুখ সারির কর্মী বা প্রয়োজনীয় সেবাদানকারী কর্মীদের গুরুত্ব মানুষ উপলব্ধি করতে পারে। এতে শ্রমজীবীদের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। এ ছাড়া ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ধরনের শ্রমিকদের মধ্যকার ব্যবধানও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

এখন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম। কোম্পানিগুলো যত চাকরির বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, চাকরিপ্রার্থীদের সংখ্যা তার চেয়ে কম। এতে শ্রমিকদের শক্তি বৃদ্ধি হয়েছে, দাবিদাওয়া নিয়ে তাঁরা আরও কঠোর অবস্থানে যেতে পারছেন।

আমেরিকান তথ্য বিশ্লেষণ কোম্পানি গ্যালাপের মতে, ১৯৬৫ সালের পর এখন শ্রমিক ইউনিয়নগুলো সবচেয়ে বেশি অনুমোদন পাচ্ছে। বেশির ভাগ কর্মী বেতন ও কর্মক্ষেত্রের সুবিধা বৃদ্ধির জন্য ইউনিয়নকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। বর্তমানে ইউনিয়নভুক্ত কর্মীরা সাধারণ কর্মীদের তুলনায় গড়ে ১০ দশমিক ২ শতাংশ বেশি মজুরি পান।

গ্যালাপের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এখনকার ধর্মঘটি শ্রমিকেরা আলোচনায় বেশ শক্ত অবস্থানে আছেন। কারণ হিসেবে তারা বলছে, ইউনিয়নগুলোর জন্য জনসাধারণের ক্রমবর্ধমান সমর্থন।

আমেরিকার ধর্মঘটের ইতিহাস

ইকোনমিক পলিসি ইনস্টিটিউট (ইপিআই) বলছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মঘট বাড়লেও এই সংখ্যা ১৯৭০–এর দশকের প্রথম দিকের তুলনায় ৭০ শতাংশ কম।

ইউনিয়নগুলোর সদস্যপদও নাটকীয়ভাবে কমে গেছে। এর কারণ কিছু রাজ্য তথাকথিত ‘কাজ করার অধিকার’ শীর্ষক আইনের মাধ্যমে ইউনিয়নগুলোর কাজের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে, আবার অনেক কোম্পানি ইউনিয়ন গঠনের বেলায় তীব্র বাধা দেয়। সে কারণেও ইউনিয়নের সংখ্যা কমছে।

যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে ১৯৮১ সালের ফেডারেল এয়ার ট্রাফিক শ্রমিকদের ধর্মঘট। সেই ঘটনা ইউনিয়নের ইতিহাসে বড় ধাক্কা হিসেবে পরিচিত। ফেডারেল এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার ইউনিয়নের ১৩ হাজার কর্মী ধর্মঘটে গেলে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান তাঁদের বরখাস্ত করেন। তবে রিগান ১৯৮০ ও ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব টিমস্টার্সের মতো কিছু ইউনিয়নের সমর্থন পেয়েছিলেন।

ইপিআইয়ের তথ্যমতে, ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মোট কর্মশক্তির ৩৩ দশমিক ৪ শতাংশ কর্মী ইউনিয়নের সদস্য হয়েছিলেন, যে হার ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এরপর ১৯৮৫ সালে এই হার ছিল ১৮ শতাংশ এবং গত বছর এই হার ছিল ১০ দশমিক ১ শতাংশ।

জোসেফ ম্যাককার্টিন বলেন, রিগান–জমানার পর ইউনিয়নের শক্তি ক্ষয় হয়। তাঁরা তখন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করেন। কোম্পানিগুলোও ইউনিয়নকে দুর্বল করার পদ্ধতি শিখে যায়।

এদিকে কর্নেল ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব লেবার রিলেশনসের ডেটাবেজের তথ্যানুসারে, গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইউনিয়নগুলো যুক্তরাষ্ট্রে ৩৯৬টি ধর্মঘট করেছে, আগের বছরের যা ছিল ৪০৯টি।

ইউএডব্লিউ বা ইউনাইটেড অটো ওয়ার্কারের প্রধান শন ফেইন আগের নেতাদের তুলনায় বেশি লড়াকু হিসেবে পরিচিত। তিনি প্রায়ই ইউনিয়নের কর্মীদের দাবি আদায়ে অতি ধনীদের তিরস্কার করেন। শন ফেইন যে এভাবে ধনীদের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারছেন তাতেই বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিকদের আন্দোলন কতটা শক্তি পাচ্ছে।

বর্তমানে শন ফেইন এবং ইউএডব্লিউয়ের নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি প্রধান গাড়ি কোম্পানির সঙ্গে আলোচনার জন্য ভিন্ন পথ অবলম্বন করেছে। ২০০৭ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত আগের চুক্তিগুলোতে ইউএডব্লিউ গাড়ি কোম্পানিগুলোকে বড় ধরনের ছাড় দিয়েছিল।

তখন অবশ্য পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল, গাড়ি কোম্পানিগুলো বছরের পর বছর লোকসান দিচ্ছিল এবং আর্থিক সংকটের কারণে অনেক কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যায় বা অনেকে ফেডারেল সরকারের আর্থিক পুনরুদ্ধার তহবিলের জন্য আবেদন করে।

আগে দেখা যেত, ইউএডব্লিউ যেকোনো একটি গাড়ি কোম্পানির বিরুদ্ধে আন্দোলন করত। একবার সেই কোম্পানির সঙ্গে কোনো বিষয়ে চুক্তি হলে ইউনিয়ন তখন অন্য গাড়ি কোম্পানিগুলোকে একই ধরনের চুক্তিতে আসতে রাজি করানোর চেষ্টা করত। কিন্তু এবার শন ফেইন ও ইউএডব্লিউ তিনটি গাড়ি কোম্পানির সঙ্গে বিরুদ্ধে একই সঙ্গে ধর্মঘটের পরিকল্পনা জানিয়েছে।

এবারের আন্দোলনের ধরনকে উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন জোসেফ ম্যাককার্টিন। তিনি আরও বলেন, এতে বোঝা যাচ্ছে, শ্রমিক নেতারা যে আগের চেয়ে আরও চৌকস ও জঙ্গি হয়েছেন, এবারের আন্দোলনে সেটাই বোঝা যাচ্ছে।