এই সংবাদ ২০২৪ সালের ২২ জুলাই প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু তখন দেশে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় এই সংবাদ সময়মতো অনলাইনে প্রকাশ করা যায়নি। ইন্টারনেট চালু হওয়ার পর এখন তা করা হলো।
করোনা মহামারির সময় মুখ থুবড়ে পড়েছিল বিশ্বের পর্যটন ও ভ্রমণ খাত। ২০২০ সালের মার্চ থেকেই বিশ্বের প্রায় সব দেশে মানুষের অবাধ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তাতে বন্ধ হয়ে যায় বিমান চলাচল ও পর্যটনকেন্দ্রগুলো। সেই বাস্তবতা অবশ্য এখন আর নেই।
২০২১ সাল থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে পর্যটন ও ভ্রমণ খাত। ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সের তথ্য অনুযায়ী, খাতটি আবার প্রাক্-মহামারি পর্যায়ে ফেরত যাচ্ছে। যদিও সূচকের মান সামগ্রিকভাবে খুব একটা বাড়েনি; ২০১৯ সালের তুলনায় বেড়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। যে ১১৯টি এই দেশ নিয়ে এই সূচক করা হয়েছে, এর মধ্যে ৭১টি দেশের মান ২০১৯ সালের তুলনায় বেড়েছে। ১১৯টি দেশের মধ্যে ১ নম্বরে আছে যুক্তরাষ্ট্র। আর বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের দেশে দেশে পর্যটনের আগমনের পরিমাণ এ বছরই প্রাক্-মহামারি পর্যায়ে ফেরত যাবে। ২০২৩ সালে যা ছিল ২০১৯ সালের ৮৮ শতাংশ। গত বছর বৈশ্বিক জিডিপিতে পর্যটন ও ভ্রমণ খাতের অবদান ছিল ৯ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন বা ৯ লাখ ৯০ হাজার কোটি ডলার। সেটিও প্রাক্-মহামারি পর্যায়ের প্রায় সমান। পর্যটক আগমনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্য; ২০২৩ সালে এই অঞ্চলের পর্যটক আগমন প্রাক্-মহামারি সময়ের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি ছিল। ইউরোপ বরাবরের মতোই স্থিতিশীল; সেই সঙ্গে আফ্রিকা, আমেরিকাসহ প্রায় অঞ্চলেই পর্যটকের আগমন বেড়েছে। এসব দেশে ২০২৩ সালে পর্যটক আগমনের সংখ্যা ছিল প্রাক্-মহামারি সময়ের প্রায় ৯০ শতাংশ। চলতি বছরও পর্যটন খাতের প্রবৃদ্ধি বাড়বে। মূলত মানুষ পুঞ্জীভূত চাহিদা মেটানো শুরু করেছে বলে পর্যটন খাত প্রাক্-মহামারি পর্যায়ে ফেরত যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পর্যটন ও ভ্রমণের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। সেই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিমান সংস্থাগুলোর সক্ষমতাও বেড়েছে। এ কারণে মহামারির সময় ভ্রমণে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা উঠে গেছে। এই প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও অবকাশযাপনের লক্ষ্যে ভ্রমণের চাহিদা যতটা বেড়েছে, বাণিজ্যিক ও অন্যান্য উদ্দেশ্যে ভ্রমণের চাহিদা অতটা বাড়েনি। এ ছাড়া শ্রমিক, পুঁজি বিনিয়োগ, উৎপাদনশীলতাসহ বিভিন্ন খাতের সরবরাহ চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বাড়েনি।
এদিকে ভ্রমণ ও পর্যটনের ক্ষেত্রে বিশ্বের সব দেশ যে একইভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তা নয়। ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সের তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপ ও এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে পর্যটন ও ভ্রমণ খাতের উপযোগী পরিবেশ বিরাজ করছে। ভ্রমণ ও পর্যটন সূচকে শীর্ষ ৩০ দেশের মধ্যে ২৬টি উচ্চ আয়ের দেশ; এগুলোর মধ্যে ১৯টি দেশ ইউরোপের, ৭টি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের, ৩টি আমেরিকা মহাদেশের, ১টি মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তরা আফ্রিকা অঞ্চলের।
২০২৪ সালের সূচকের শীর্ষ দেশগুলো হলো যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, জাপান, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, চীন, ইতালি ও সুইজারল্যান্ড। বিভিন্ন ধরনের বন্দোবস্তের কারণে এই দেশগুলো এগিয়ে আছে। যেমন এসব দেশের অনুকূল ব্যবসায়িক পরিবেশ, ভ্রমণের উন্মুক্ত নীতি, উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, পর্যটন ও তথ্যপ্রযুক্তির অবকাঠামো, প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণ। ২০২২ সালের প্রতিবেদনে শীর্ষ ৩০টি দেশের জিডিপি ছিল এই সূচকভুক্ত দেশগুলোর মোট জিডিপির ৭৫ শতাংশ; ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে এই দেশগুলোর যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার ৭০ শতাংশ হয়েছে সেই ৩০ দেশে।
২০১৯ সালের পর যে ৭১টি দেশের সূচকের উন্নতি হয়েছে, এর মধ্যে ৫২টি দেশ নিম্ন ও উচ্চমধ্যম আয়ের কাতারে পড়ে। এই সময়ে যে ১০টি দেশ সূচকে সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছে, তার মধ্যে কেবল সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত উচ্চ আয়ের দেশ, বাকি দেশগুলো উন্নয়নশীল। এই সময়ে সৌদি আরব ৫০তম স্থান থেকে ৪১তম স্থানে উঠে এসেছে; সংযুক্ত আরব আমিরাত ২৫তম স্থান থেকে ১৮তম স্থানে উঠে এসেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে আছে উজবেকিস্তান (৯৪ থেকে ৭৮তম), আইভরি কোস্ট (১১৬ থেকে ১১৪তম), আলবেনিয়া (৭৮ থেকে ৬৬তম), তানজানিয়া (৮৮ থেকে ৮১তম), ইন্দোনেশিয়া (৩৬ থেকে ২২তম), মিসর (৬৬ থেকে ৬১তম), নাইজেরিয়া (১১৩ থেকে ১১২তম), এল সালভাদর (১০১ থেকে ৯৭তম)।
নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি গড় মানের চেয়ে বেশি হলেও সূচকে যেসব দেশ গড় মানের চেয়ে কম নম্বর পেয়েছে, তার মধ্যে ৯০টি দেশ এই কাতারের। ফলে সূচকে তাদের মান বাড়াতে পর্যটনের মানোন্নয়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আবাসন, যোগযোগ, ভ্রমণের পরিবেশ ও অভিজ্ঞতা—এসব বিষয়ে উন্নতির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে পর্যটন ও ভ্রমণ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এখন শুধু চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্যহীনতার মতো স্বল্পমেয়াদি বিষয়গুলো আমলে নিলে চলবে না; একই সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, পরিবেশ ও প্রযুক্তি খাতে যেসব চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ আসছে, সেগুলো আমলে নিতে হবে। তা করতে পারলে ভ্রমণ ও পর্যটন খাত বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে।
মোট ৫টি সূচক ও ১৭টি উপসূচকের ভিত্তিতে ভ্রমণ ও পর্যটনের এই সূচক প্রণয়ন করা হয়েছে। পাঁচটি সূচক হচ্ছে সহায়ক পরিবেশ (উপসূচক: ব্যবসার পরিবেশ, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, মানবসম্পদ ও শ্রমবাজার, তথ্যপ্রযুক্তির প্রস্তুতি), ভ্রমণ ও পর্যটননীতি (অগ্রাধিকার, উন্মুক্ততা, পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক মূল্য); অবকাঠামো ও সেবা (বিমান চলাচলের অবকাঠামো, স্থল ও বন্দর অবকাঠামো, পর্যটক সেবা ও অবকাঠামো); পর্যটন ও ভ্রমণের সম্পদ (প্রাকৃতিক সম্পদ, সাংস্কৃতিক সম্পদ, অবসর ব্যতীত অন্যান্য সম্পদ); পর্যটন ও ভ্রমণ খাতের স্থায়িত্ব (টেকসই পরিবেশ, পর্যটন ও ভ্রমণ খাতের আর্থসামাজিক প্রভাব, পর্যটন ও ভ্রমণ চাহিদার স্থায়িত্ব)।