বিশ্বের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর সঙ্গে নিচের সারির ৫০ শতাংশ মানুষের সম্পদের ব্যবধান আরও বেড়েছে। গত এক দশকে এই ১ শতাংশ ধনী আরও ৪২ ট্রিলিয়ন বা ৪২ লাখ কোটি ডলার সম্পদের মালিক হয়েছেন। নিচের সারির ৫০ শতাংশ মানুষের সম্পদ আহরণের চেয়ে তা ৫০ শতাংশ বেশি।
সম্প্রতি ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত জি–২০–ভুক্ত দেশগুলোর অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের সম্মেলনের আগে আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফাম এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করে।
প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, গত এক দশকে বিশ্বের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর প্রত্যেকের সম্পদ প্রায় ৪ লাখ ডলার করে বেড়েছে; একই সময়ে নিচের সারির ৫০ শতাংশ মানুষের সম্পদ বেড়েছে গড়ে ৩৩৫ ডলার। অর্থাৎ গড়ে তাঁদের সম্পদ বেড়েছে দৈনিক ৯ সেন্ট।
মূলত অতিধনীদের ওপর কর বৃদ্ধির বিষয়ে জি–২০–ভুক্ত দেশের অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নররা মিলিত হয়েছিলেন। দুই দিনের বৈঠক শেষে মন্ত্রী পর্যায়ের যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, অতিধনীদের ওপর কর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একযোগে কাজ করা হবে।
ঘোষণায় আরও বলা হয়েছে, সার্বভৌম দেশের করনীতি কেমন হবে, তা নির্ভর করবে সেই দেশের ওপর। এ নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে অতিধনীদের ওপর করারোপে দেশগুলো পরস্পরকে সহযোগিতা করবে।
জানা গেছে, চলতি বছরের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠেয় জি–২০ শীর্ষ সম্মেলনের আগে ব্রাজিল বিলিয়নিয়ার বা শতকোটিপতিদের ২ শতাংশ ন্যূনতম সম্পদ আরোপের প্রস্তাব দিয়েছে। বৈশ্বিকভাবে এই অতিধনীদের ওপর কী হারে করারোপ করা হবে, সে বিষয়ে কার্যকর ঐকমত্য না হলেও ব্রাজিলের অর্থমন্ত্রী ফার্নান্দো হাডাড বলেছেন, এবারের সম্মেলনে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালের অসমতা–বিষয়ক বিভাগের প্রধান ম্যাক্স লসন বলেছেন, এখন পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার মানুষকে এই অসমতার বিপর্যয়কর প্রভাব থেকে বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ মানুষ নিজেদের পকেট ভরিয়েই যাচ্ছেন; অন্যদিকে নিচের সারির মানুষেরা কায়ক্লেশে জীবন ধারণ করছেন।
অসমতা অশ্লীল পর্যায়ে চলে গেছে বলে অক্সফাম মনে করলেও দেশে দেশে দেখা যায়, অতিধনী ও ধনীদের ওপর কর যেন কমছেই। অক্সফামের হিসাবেই দেখা যায়, জি–২০–ভুক্ত দেশগুলো থেকে আদায় হওয়া প্রতি ১ ডলার করের মধ্যে মাত্র ৮ সেন্ট আসছে সম্পদকর থেকে। তারা আরও দেখেছে, গত ৪০ বছরে বিশ্বের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর আয় ৪৫ শতাংশ বেড়েছে; একই সময়ে সর্বোচ্চ করহার এক-তৃতীয়াংশ কমেছে। ফলে শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর সম্পদ যে বাড়ছে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। সেই সঙ্গে ধনীদের দেওয়া কর কমছে।
সারা বিশ্বের শতকোটিপতিরা খুব কম হারে কর দেন। অক্সফাম বলছে, এই ধনীরা সম্পদের মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ কর দেন। ৪০ বছর ধরে এই ধনীদের সম্পদ বেড়েছে বছরে গড়ে ৭ দশমিক ১ শতাংশ হারে। এ বাস্তবতায় অক্সফাম মনে করছে, অতি বৈষম্য কমাতে এই ধনীদের নিট সম্পদকর হওয়া উচিত ৮ শতাংশ।
বিশ্বের ৮০ শতাংশ শতকোটিপতির বসবাস জি–২০–ভুক্ত দেশগুলোয়। শতকোটিপতিদের ওপর করারোপের ক্ষেত্রে জি–২০-এর নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা প্রয়োজন বলে অক্সফাম মনে করে।
ধনীদের ওপর কর বৃদ্ধির দাবি বিশ্বের সব দেশেই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। জি–২০-এর বিভিন্ন জরিপে এ বাস্তবতা উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, ভারতের ৮০ শতাংশ ও ব্রাজিলের ৬৯ শতাংশ মানুষ ধনীদের ওপর কর বৃদ্ধির পক্ষে মত দিয়েছেন।
এ ছাড়া মিলিয়নিয়ার বা যাঁদের সম্পদমূল্য অন্তত ১০ লাখ ডলার, তাঁরাও ধনীদের কর বৃদ্ধির পক্ষে। জি–২০–ভুক্ত দেশগুলোর এই শ্রেণির মানুষকে নিয়ে করা জরিপে দেখা গেছে, প্রায় তিন-চতুর্থাংশই মনে করেন, ধনীদের কর বাড়ানো উচিত। তাঁদের অর্ধেকের বেশি মনে করেন, অতি বৈষম্য গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। ৭২ শতাংশ মনে করেন, অতিধনীরা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করছেন।
জি–২০ সম্মেলনে অংশ নেওয়া অর্থমন্ত্রীরা বলেছেন, এককভাবে কোনো দেশের পক্ষে ধনীদের কর বৃদ্ধি করা কঠিন। কারণ হিসেবে তাঁরা বলেন, সেটা হলে ধনীরা এক দেশ থেকে আরেক দেশে অর্থ পাচার করবেন।
ব্রাজিলিয়ান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসের জ্যেষ্ঠ ফেলো রজারিও স্টুডার্ট বলেন, জি–২০–ভুক্ত দেশগুলো একযোগে কাজ করলে সবাই লাভবান হবে; কিন্তু দেশগুলো এককভাবে কাজ করলে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।
এদিকে চলতি বছরের শুরুতে দাভোস সম্মেলনের সময় আরেক প্রতিবেদনে অক্সফাম বলে, বিশ্বের অতিধনীদের সম্পদের পরিমাণ বাড়ছেই। ২০২০ সালের পর বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ ধনীর সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে ৮৬৯ বিলিয়ন বা ৮৬ হাজার ৯০০ কোটি ডলারে উঠেছে। ঠিক এই সময়ে বিশ্বের ৫০০ কোটি মানুষ আগের চেয়ে আরও গরিব হয়েছে।