যে সময় চীন ধীরগতির অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করতে নতুন পদক্ষেপ ঘোষণা করল, ঠিক সেই সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। তাঁর যে অতীত রেকর্ড ও এবারের নির্বাচনের অঙ্গীকার, তাতে চীনের চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
এবারের প্রেক্ষাপট হলো, নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্প চীন থেকে আমদানি করা পণ্যে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং দেশটিকে প্রযুক্তিগত পরাশক্তিতে পরিণত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই বিজয় এখন তাঁর পরিকল্পনায় বাদ সাধবে বলেই মনে করা হচ্ছে। এটি স্পষ্ট, ট্রাম্পের বিজয় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক পরাশক্তির ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে। খবর বিবিসি।
সম্পত্তির মন্দা বাজার, সরকারের ঋণ ও বেকারত্ব বৃদ্ধি আর ব্যক্তিগত ভোগব্যয় কমে যাওয়ায় চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি মন্থর হয়ে গেছে। সংকট আগে থেকেই ছিল, করোনা মহামারির পর তা আরও বেড়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন, তখন তিনি চীনের পণ্যে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছিলেন। চীন–বিশ্লেষক বিল বিশপ বলেন, নতুন শুল্ক পরিকল্পনার বিষয়ে ট্রাম্প যা বলেছেন, তা আক্ষরিকভাবেই গ্রহণ করা উচিত। ট্রাম্প মনে করেন, চীন অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে এবং চীন ও কোভিড-১৯-এর কারণে ২০২০ সালের নির্বাচনে তাঁকে হারতে হয়েছে।
২০২১ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউস ত্যাগ করার পরও চীনের ওপর ওয়াশিংটনের চাপ কমেনি। বাইডেন প্রশাসন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে আরোপ করা সেই পদক্ষেপগুলো অব্যাহত রেখেছে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে তা আরও বিস্তৃত করেছে।
প্রথম দফায় ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করায় চীন ধাক্কা খেয়েছিল তবে চীন এখন আরও দুর্বল। দুই বছর আগে করোনা–সম্পর্কিত কঠোর বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর চীন অর্থনীতিকে মহামারি–পূর্ববর্তী প্রবৃদ্ধির স্তরে ফিরিয়ে নিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। তারা আশা করেছিল, দ্রুত পুনরুদ্ধার হবে। কিন্তু তা তো হয়নি, বরং চীনের অর্থনৈতিক সংবাদ এখন হতাশাজনক।
গত সেপ্টেম্বরে চীন অর্থনীতির পালে হাওয়া লাগাতে কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) দেশটির বার্ষিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস হ্রাস করে। আইএমএফ আশা করছে, ২০২৪ সালে চীনের প্রবৃদ্ধি হবে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। পরবর্তীকালে চীনের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি আরও কমে ৪ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছাবে বলে তারা ধারণা করছে।
কয়েক দশক উচ্চ প্রবৃদ্ধির পর চীনের অর্থনীতির গতি যে কমে যাবে, সে জন্য দেশটির নেতারা প্রস্তুত ছিলেন। ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেছিলেন, দ্রুত প্রবৃদ্ধি থেকে উচ্চমানের উন্নয়নের পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পরিকল্পনা করছে চীন। উন্নত উৎপাদন ও পরিবেশবান্ধব শিল্পের কল্যাণে চীনের অর্থনীতির মোড় ঘুরে যাবে—এটা বোঝাতে পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বলা ওই কথাটি চীনের কর্মকর্তারা বারবার ব্যবহার করেছেন।
কিন্তু কিছু অর্থনীতিবিদ বলেন, চীন শুধু রপ্তানি করে সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। মর্গান স্ট্যানলি এশিয়ার সাবেক চেয়ারম্যান স্টিফেন রোচ বলেন, চীন সতর্ক না হলে তার পরিণতি জাপানের মতো হতে পারে, অর্থাৎ কয়েক দশকের দীর্ঘ স্থবিরতার মুখে পড়তে পারে তারা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৯০-এর দশকে এসে প্রথমবার জাপান দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে। রোচ বলেন, তেমন পরিস্থিতি এড়াতে চীনকে অনাবিষ্কৃত ভোক্তা চাহিদার ওপর নির্ভর করতে হবে এবং রপ্তানি ও বিনিয়োগনির্ভর প্রবৃদ্ধি থেকে সরে আসতে হবে। এতে শুধু টেকসই প্রবৃদ্ধি উৎসাহিত হবে না, বরং ‘বাণিজ্যিক উত্তেজনা ও [চীনের] বাইরের ঝুঁকি কমাতে’ তা সহায়ক হবে বলে মনে করেন তিনি।
মোদ্দাকথা হলো, দ্বিতীয় দফায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসার মধ্য দিয়ে যে হুমকি তৈরি হয়েছে, তা মোকাবিলা করতে আরও শক্তিশালী অর্থনৈতিক মডেল তৈরি করতে হবে চীনকে।
দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বব্যাপী কম খরচে পণ্য তৈরির কারখানা হিসেবে পরিচিত চীন। তারা এখন সেই পরিচিতি উচ্চ প্রযুক্তি পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করছে।
সৌর প্যানেল, বৈদ্যুতিক গাড়ি ও লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির ক্ষেত্রে বিশ্বের নেতৃত্বস্থানীয় দেশ চীন। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির (আইইএ) তথ্যানুসারে, বিশ্বে সৌর প্যানেল উৎপাদনের অন্তত ৮০ শতাংশ হিস্যা এখন চীনের। দেশটি বৈদ্যুতিক গাড়ি ও ব্যাটারির সবচেয়ে বড় উৎস।
আইইএ গত বছর বলেছিল, পরিবেশবান্ধব জ্বালানিতে চীনের বিনিয়োগ বিশ্বের মোট বিনিয়োগের এক-তৃতীয়াংশ। কারণ দেশটি ‘নবায়নযোগ্য শক্তিতে সক্ষমতা বাড়াতে অব্যাহতভাবে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করছে’।
উচ্চ প্রযুক্তিভিত্তিক উৎপাদনে অগ্রণী হতে চীন সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, এটা নিশ্চিত। লন্ডনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক চ্যাটহ্যাম হাউসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ডেভিড লুবিন বলেন, চীনের এই উদ্যোগ সফল হয়েছে।
২০২৩ সালে চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ি, লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি ও সৌর প্যানেলের রপ্তানি ৩০ শতাংশ বেড়েছে; অর্থের পরিমাণের দিক থেকে তা এক ট্রিলিয়ন ইয়ান বা ১৩ হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এসব শিল্পে চীন বৈশ্বিক আধিপত্য করতে শুরু করেছে। এই রপ্তানি বৃদ্ধির ফলে চীনের অর্থনীতিতে চলমান সম্পত্তি সংকটের অভিঘাত কিছুটা কমেছে
চীনের ক্ষমতা বাড়বে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। প্রবৃদ্ধির আর কোনো উৎসও তাদের নেই বলে মনে করেন ন্যাটিক্সিস ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের এশিয়া প্রশান্ত অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ অ্যালিসিয়া গার্সিয়া-হেরেরো।
বিবিসির সংবাদে বলা হয়েছে, চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ি ও সৌর উপকরণ রপ্তানি বৃদ্ধির সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিরোধের মুখে পড়েছে তারা। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, গত মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন চীনে তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়িতে শুল্ক ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত করেছে।
এখনকার সমস্যা হলো, সেই পণ্যগুলোর বড় গ্রাহকেরা, যার মধ্যে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রও আছে, তারা ক্রমেই চীনের এসব পণ্য নিতে চাচ্ছে না, মুডি'স অ্যানালিটিকসের গবেষণা পরিচালক ক্যাটরিনা এল এ কথা বলেন।
ট্রাম্প আবার জিতেছেন এবং তিনি এখন ক্ষমতা ও দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এই পরিস্থিতিতে বেইজিংকে আত্মজিজ্ঞাসা করতে হবে, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সম্প্রতি তাদের গৃহীত পদক্ষেপগুলো যথেষ্ট হবে কি না।