ইয়েন
ইয়েন

কেন ৩৮ বছরের মধ্যে ইয়েন সবচেয়ে সস্তা, তাতে জাপানের সমস্যা কী হচ্ছে

গত ৩৮ বছরের মধ্যে জাপানি মুদ্রা ইয়েনের দর সবচেয়ে নিচে নেমে গেছে। প্রতি মার্কিন ডলারে এখন ১৬০ ইয়েনের বেশি পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ বিশ্বের প্রধান প্রধান মুদ্রার বিপরীতে জাপানি মুদ্রা রীতিমতো ধুঁকছে। দেশটির কর্তৃপক্ষ ইয়েনকে চাঙা করতে হস্তক্ষেপ করবে, বাজারে এমন প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে।

মুদ্রা কেনাবেচা করেন, এমন ব্যবসায়ীরা এখন অপেক্ষা করছেন ইয়েনের দাম বাড়াতে কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয় কি না, তার ইঙ্গিত পেতে। তবে ইয়েন পায়ের নিচে সামান্য মাটি খুঁজে পেয়েছে বৃহস্পতিবার সকালে। মার্কিন ডলার আগের চেয়েও চাঙা হয়েছিল, তবে ট্রেজারি বিল থেকে পাওয়া সুদ খানিকটা কমে যাওয়ায় ডলারের দরও অন্যান্য প্রধান মুদ্রার তুলনায় কিছুটা দুর্বল হয়েছে।

ডলার অবশ্য এখনো আট সপ্তাহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
রয়টার্সের তথ্যে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার বাজারে প্রতি ডলারের দাম ছিল ১৬০ দশমিক ৪৭ জাপানি ইয়েন। বুধবার এই দাম নেমেছিল ১৬০ দশমিক ৮৮ ইয়েনে। ১৯৮৬ সালের পর এটাই ছিল ডলারের বিপরীতে ইয়েনের সর্বনিম্ন দর। চলতি মাসে এখন পর্যন্ত ইয়েনের দাম কমেছে ২ শতাংশ, আর এ বছরে কমেছে ১২ শতাংশ। এর বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েই চলেছে।

কেন ইয়েন খাদে নামছে

ইয়েনের দাম কমার মূল কারণ ডলারের চাঙা ভাব। মার্কিন ডলার দীর্ঘ সময় ধরে দারুণ চাঙা। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার এক দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে উঁচুতে নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে। বিশ্বের প্রায় সব মুদ্রার বিপরীতেই ডলারের দাম এখন বেশি।

জাপানি মুদ্রার দাম দ্রুত পড়ার দ্বিতীয় যে কারণ সেটি হলো, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হারের বিপুল পার্থক্য। ইয়েনকে অনেক মুদ্রা ব্যবসায়ী ‘ক্যারি ট্রেড’ ব্যবসার কাজে ব্যবহার করছে। এ ব্যবসায় একজন বিনিয়োগকারী সেই মুদ্রায় অর্থ ধার করে, যাতে সুদের হার কম। পরে ওই অর্থ বিনিয়োগ করে এমন সম্পদে, যেখান থেকে অনেক বেশি মুনাফা পাওয়া যায়।

মুদ্রা ব্যবসায়ীরা ইয়েনের ক্ষেত্রে ঠিক সেটিই করছেন। দশকের পর দশক ধরে জাপানে সুদের হার ছিল অত্যন্ত কম। এমনকি এই হার কিছুদিন আগপর্যন্ত ঋণাত্মকও ছিল। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে জাপানে কিছু ক্ষেত্রে সুদের হার ধণাত্মক করা হয়েছে। অন্যদিকে কোভিডের সময় যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার কম থাকলেও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে দেশটিতে সুদের হার বাড়তে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার বাড়লে তা বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশাল সুযোগ তৈরি করে। সরকারি বন্ডের মতো পণ্যে বিনিয়োগ করে তাঁরা বিপুল মুনাফা লাভ করতে পারেন। সে সুযোগ তাঁরা জাপানে পাচ্ছেন না। ফলে যত বেশি বিনিয়োগকারী ইয়েন বিক্রি করে ডলার কিনবেন, ততই জাপানি মুদ্রার দাম কমে যাবে। আর ইয়েনের দাম যতই কমবে, আরও বেশি ক্ষতি এড়াতে বিনিয়োগকারীরা এই মুদ্রা তত বেশিই বিক্রি করবেন।

ইয়েনের ক্ষেত্রে এখন সেটিই ঘটছে। ফেডারেল রিজার্ভের নীতি সুদের হার এখন ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে ব্যাংক অব জাপানের সুদের হার শূন্য শতাংশ থেকে শুরু করে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ।

কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ

ডলারের দাম আবারও ১৬০ ইয়েনের মাইলফলকের নিচে নেমে যাওয়ার ফলে মুদ্রা ব্যবসায়ীরা মনে করছেন জাপানি কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে। এর আগে গত মে মাসে একবার ডলারের দর ১৬০ ইয়েনকে ছাড়িয়েছিল। সে সময় প্রতি ডলারের দর ছিল ১৬০ দশমিক ২৪ ইয়েন, যা ছিল ৩৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

পরিস্থিতি সামাল দিতে কর্তৃপক্ষ তখন ৬ হাজার ৮৪ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ৯ লাখ ৭৯ হাজার কোটি ইয়েন খরচ করেছিল। তখন তাতে কিছুটা কাজও হয়। বাজারে হস্তক্ষেপ করার পর ইয়েনের দাম ৫ শতাংশ বাড়ে।

তবে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বাজারে হস্তক্ষেপের ঝুঁকি বাড়লেও জাপানের কর্তৃপক্ষ সম্ভবত শুক্রবার পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। কারণ, ওই দিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যক্তিগত ভোক্তা ব্যয় মূল্যসূচক প্রকাশ করা হবে। তবে তারপরও কর্তৃপক্ষ কোনো হস্তক্ষেপ করলেও তার প্রভাব খুবই সীমিত হবে বলে বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন।

পিকটেট ওয়েলথ ম্যানেজমেন্টের এশিয়াবিষয়ক গবেষণা বিভাগের প্রধান ডং চেন রয়টার্সকে বলেন, ‘আমি মনে করি না জাপানি কর্তৃপক্ষ খুব বেশি কিছু করতে পারবে। বাজারে সেটা দেখা যাচ্ছে। মুখের কথা আর সত্যিকার হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তারা যা করেছে, তাতে ইয়েনের পতন থামেনি। আমরা প্রত্যাশা করছি, ইয়েন দুর্বলই থাকবে।’

ইয়েন দুর্বল হলে সমস্যা কী

একটি দুর্বল মুদ্রার ভালো–খারাপ দুটি দিকই আছে।
দুর্বল ইয়েনের কারণে জাপানের রপ্তানিকারকদের মুনাফা বাড়ছে। জাপানি মুদ্রা দুর্বল থাকায় দেশটির পণ্য বিশ্ববাজারে কম দামে বিক্রি হচ্ছে। ফলে রপ্তানি বাজারে জাপানি পণ্য ভালো করছে।

দ্বিতীয়ত, ইয়েন সস্তা হওয়ার কারণে রেকর্ড সংখ্যক মানুষ জাপানে বেড়াতে যেতে আগ্রহী হয়েছেন। ডলার বিক্রি করে যেহেতু বেশি ইয়েন পাওয়া যাচ্ছে, তাই জাপানে কম অর্থ খরচ করেই ভ্রমণ করা যাচ্ছে। কেবল গত মার্চ মাসেই ৩১ লাখ বিদেশি জাপান ভ্রমণ করেছেন। এই পর্যটকেরা জাপানে অর্থ ব্যয় করেছেন, ফলে স্থানীয় ব্যবসা চাঙা হয়েছে।

তবে জাপানের সমস্যাও হচ্ছে। দুর্বল ইয়েনের কারণে আমদানি খরচ বেশ অনেকটা বেড়েছে। বিশেষ করে খাদ্য ও জ্বালানি আমদানির খরচ। ফলে সাধারণ মানুষের সংসার খরচ বেড়ে গেছে।

আবার জাপানের অনেক কোম্পানি বিদেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কার্যক্রম চালায়। ফলে দুর্বল ইয়েনের কারণে রপ্তানিতে যে সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, সেই সুবিধা থেকে এসব কোম্পানি বঞ্চিত হচ্ছে। এসব কোম্পানির বেশির ভাগই আবার বেশ বড় বড় প্রতিষ্ঠান।

জাপানি মুদ্রার বিনিময় হার খুব বেশি কমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে জাপানি কর্তকর্তারা অনেকবারই তাঁদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন যে বাজারে হস্তক্ষেপ করতে কর্তৃপক্ষ প্রস্তুত। মূলত দুটি কাজ তাঁরা করতে পারেন—বাজার থেকে ইয়েন কিনে দাম বাড়ানো অথবা সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়া। কোন পথে তাঁরা হাঁটবেন, তা অবশ্য এখনো পরিষ্কার নয়।