বিশ্বে বিশেষায়িত দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর হার ৫৩%–এ উন্নীত হয়েছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে ৪৪% কর্মীর দক্ষতা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ব্যবহার করে সংবাদ পরিবেশন করে হইচই ফেলে দিয়েছে। দেশে এটি নতুন হলেও সারা বিশ্বে কয়েক বছর ধরে এই প্রবণতা চলছে।
সে জন্য এআই মানুষের কাজ কেড়ে নেবে বা নতুন বাস্তবতায় টিকে থাকতে হলে মানুষকে নতুন দক্ষতা রপ্ত করতে হবে, এমন কথা হামেশাই বলা হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) এক জরিপে দেখা গেছে, নিয়োগদাতারা মনে করেন, আগামী পাঁচ বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে ৪৪ শতাংশ কর্মীর দক্ষতা অনেকটাই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে।
কিন্তু প্রাইসওয়াটারহাউসকুপার্সের (পিডব্লিউসি) এক জরিপে দেখা গেছে, কর্মীরা এই পরিবর্তনের বিষয় ঠিকঠাক ঠাহরই করতে পারছেন না। পিডব্লিউসির জরিপে অংশ নেওয়া মাত্র ৩৬ শতাংশ কর্মী জোরালো ও মৃদুভাবে মনে করছেন, কর্মক্ষেত্রে সফল হওয়ার জন্য যেসব দক্ষতা প্রয়োজন, আগামী পাঁচ বছরে সেখানে অনেক বড় পরিবর্তন আসবে।
৪৩ শতাংশ বলেছেন, কাজের জগতে প্রয়োজনীয় দক্ষতায় যে পরিবর্তন আসবে, সে বিষয়ে তাঁদের পরিষ্কার ধারণা আছে। পিডব্লিউসি ২০১৯ সাল থেকে ‘গ্লোবাল ওয়ার্কফোর্স হোপস অ্যান্ড ফিয়ার্স বা বৈশ্বিক শ্রমশক্তির আশা ও শঙ্কা’ শীর্ষক এই জরিপ করে আসছে। এবার তারা চতুর্থ জরিপের ফল প্রকাশ করেছে। এতে বিশ্বের ৪৬টি দেশের ৫৪ হাজার কর্মী অংশ নিয়েছেন।
পিডব্লিউসির জরিপে বলা হয়েছে, কর্মীদের মধ্যে পরিবর্তনের বিষয়ে পরিষ্কার ধারণার অভাব রয়েছে, এটা উদ্বেগজনক। কারণ, তাঁরা বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বুঝতে না পারলে নতুন দক্ষতা রপ্ত করে নিজেদের ভূমিকায় প্রাসঙ্গিক ও কার্যকর থাকার জন্য যে যথাযথ প্রস্তুতি দরকার, সেটি তাঁরা নিতে পারবেন না। তবে পিডব্লিউসি মনে করছে, এর চেয়েও বড় উদ্বেগের কারণ আছে। সেটি হলো, যেসব কাজে বিশেষায়িত দক্ষতা বা প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না, সেসব ক্ষেত্রে নিয়োজিত কর্মীরা একরকম মনেই করছেন না যে পরিবর্তন আসছে। বিশেষায়িত কাজে নিয়োজিত কর্মীদের মধ্যে ৫১ শতাংশ মনে করছেন আগামী পাঁচ বছরে তাঁদের কাজে টিকে থাকতে হলে নতুন দক্ষতা রপ্ত করতে হবে।
অন্যদিকে বিশেষায়িত দক্ষতার প্রয়োজন নেই এমন কাজে নিয়োজিত কর্মীদের মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ মনে করেন, আগামী পাঁচ বছরে তাঁদের নতুন দক্ষতা রপ্ত করতে হবে। কোম্পানিগুলো এখন ক্রমবর্ধমান হারে অটোমেশন তথা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় যাবে এবং এআই ব্যবহার করবে। এর ফলে যাঁদের বিশেষায়িত দক্ষতার অভাব আছে, তাঁদের চাকরি হারানোর আশঙ্কা আছে। পিডব্লিউসির জরিপ অনুযায়ী বিশ্বে বিশেষায়িত দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর সংখ্যা অবশ্য বাড়ছে। আগের জরিপে যেখানে এই ধরনের কর্মীর হার ছিল ৪৯ শতাংশ, সেখানে এবার তা ৫৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এই কর্মীরা বরং নতুন প্রযুক্তি ও পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে অধিকতর প্রস্তুত বলে দাবি করছেন।
বিশেষায়িত দক্ষতাসম্পন্ন ৬০ শতাংশ কর্মীই বলেছেন, আগামী পাঁচ বছরে কাজ করতে কোন ধরনের নতুন দক্ষতার প্রয়োজন হবে, সে বিষয়ে তাঁদের পরিষ্কার ধারণা আছে। অথচ বিশেষায়িত দক্ষতাহীন কর্মীদের মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তাঁদের পরিষ্কার ধারণা আছে। বিষয়টি হলো, বর্তমান বিশ্বে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বাড়ছে। সব ক্ষেত্রেই এর ব্যবহার দেখা যাচ্ছে, সেটি মৌলিক গবেষণা হোক কিংবা বিবিধ বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাতেই হোক। টেক্সট, ভয়েস বা ফেসিয়াল রিকগনিশন কিংবা নির্ভুল মেশিন অনুবাদে এআই সফলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এ ছাড়া অন্য সব কাজ, যেগুলো অটোমেটেড করা সম্ভব, সেগুলোতেও এআই ব্যবহারের চেষ্টা চলছে। বলা যায়, এআই নিছক অভিনবত্বের ধারা থেকে বেরিয়ে এসে খুব দ্রুতই বিস্তৃত অর্থনৈতিক প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে, বিশ্লেষকেরা এমনটাই মনে করছেন। এই বাস্তবতায় পিডব্লিউসি জরিপটি করেছে। এতে দেখা গেছে, পদোন্নতি ও বেতন বৃদ্ধির দাবি করার ক্ষেত্রে বিশেষায়িত দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীরা অন্যদের চেয়ে প্রায় দেড় গুণ এগিয়ে থাকছেন।
মনোভাবের দিক থেকেও উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের সঙ্গে অন্যদের ব্যবধান আছে। জরিপ মতে, উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীরা মানবীয় দক্ষতা নিয়ে অতটা চিন্তিত নন, অর্থাৎ মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা, নমনীয়তা, সমালোচনামূলক চিন্তাÑকর্মক্ষেত্রে উন্নতির জন্য এসব জরুরি, এমন কথা উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীরা তেমন একটা বলেন না। যদিও এ ক্ষেত্রে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) জরিপের ফলাফলের সঙ্গে পিডব্লিউসির জরিপের অনেক পার্থক্য দেখা যায়।
শেষমেশ পিডব্লিউসি মনে করছে, উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন ও উচ্চদক্ষতাহীন কর্মীদের মধ্যে ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে। এতে তাঁদের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে কর্মীরা নতুন দক্ষতা রপ্ত করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকবেন বা নতুন পরিবেশ মানিয়ে নিতে পারবেন না, টিকে থাকতে তাঁদের অনেক সংগ্রাম করতে হবে। তাঁদের এই ঘাটতির কারণে কোম্পানির উৎপাদনশীলতাও ব্যাহত হবে। এই বাস্তবতায় প্রধান নির্বাহী ও জ্যেষ্ঠ নির্বাহীদের কাজ হচ্ছে, কর্মীদের নতুন দক্ষতা রপ্ত করতে উৎসাহিত করা।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, আজকের যুগে তরণদের কোডিং দক্ষতা বা কম্পিউটার বিজ্ঞানের জ্ঞানের পাশাপাশি গণিত, পরিসংখ্যানসহ সমাজবিজ্ঞানও পাঠ করা উচিত। বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ সমস্যাই জটিল, তার সমাধানে দরকার ইন্টার ডিসিপ্লিনারি বা বহুমাত্রিক জ্ঞান। ভবিষ্যতের এআই নির্ভর দুনিয়ায় মানুষের সবচেয়ে বেশি যেটি প্রয়োজন তা ক্রিটিক্যাল থিংকিং, মানে একটি বিষয়কে নানান দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে পারা। যদিও বাংলাদেশের মতো দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এ ক্ষেত্রে জোর দেওয়া হয় সবচেয়ে কম।