ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশের কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে দ্রুত ছড়িয়েছে। এপ্রিলের শেষ নাগাদ কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই চার শতাধিক বিক্ষোভ হয়েছে। একই রকমের বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে প্রতিবেশী কানাডা আর পশ্চিমা অনেক দেশে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, শিক্ষার্থীদের সুনির্দিষ্ট দাবি একেক জায়গায় একেক রকম। তবে একটা বিষয় মোটামুটি সব বিক্ষোভে সর্বজনীন, সেটি হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে আর্থিক সক্ষমতা রয়েছে, সেটা ব্যবহার করেই ইসরায়েলের ওপর চাপ তৈরি করা। এই আর্থিক সক্ষমতার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রভাবকেও ব্যবহারের জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
প্রতিবাদকারীরা চাইছেন বিনিয়োগ প্রত্যাহার। তার মানে, ইসরায়েলি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত আর্থিক সম্পদ বিক্রি করা অথবা ইসরায়েলের সেনাবাহিনীকে সহায়তা করে বলে ধারণা রয়েছে এমন বড় করপোরেশনগুলোর শেয়ার ছেড়ে দেওয়া। এর বাইরে অনেক বিক্ষোভে দাবি তোলা হয়েছে যে ইসরায়েলের সঙ্গে আর্থিক সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করা হোক। এমনটি দেশটির সঙ্গে শিক্ষাসম্পর্কিত যোগাযোগ কিংবা শিক্ষামূলক লেনদেনও বন্ধ করার দাবি উঠেছে।
ইসরায়েল গাজায় যে বোমাবর্ষণ ও সামরিক অভিযান চালাচ্ছে, তার প্রতিবাদে এসব দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর দেশটি গাজায় এই অভিযান চালাচ্ছে, যাতে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে ওঠা এই দাবি অবশ্য হঠাৎ করে আসেনি। ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে গাজা অবরুদ্ধ করে রেখেছে। পাশাপাশি পশ্চিম তীর ও গাজায় ইসরায়েলি সামরিক দখলদারত্ব রয়েছে অর্ধশত বছর ধরে। এরই প্রতিবাদে প্রায় ২০ বছর আগে শুরু হয় এক আন্দোলনের, যেটি পরিচিত ‘বর্জন, ব্যবসা বা বিনিয়োগ প্রত্যাহার ও নিষেধাজ্ঞা’ আন্দোলন, সংক্ষেপে বিডিএস।
বিডিএস কৌশল
২০০৫ সালে ১৭০টি ফিলিস্তিনি নাগরিক গোষ্ঠী এক হয়ে বিডিএস আন্দোলন শুরু করে। এরপর অনেক শিক্ষার্থী সংগঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক সংগঠন ও নানা রকম গোষ্ঠী এর সঙ্গে যুক্ত হয়।
বিডিএস আন্দোলনকারীরা ইসরায়েলে তৈরি পণ্য বর্জন করতে বিশ্বব্যাপী ভোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানান। তাঁরা চান, ভোক্তারা ইসরায়েলি সিনেমা, সংগীত এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক পণ্যের জন্য যেন অর্থ খরচ না করেন। ইসরায়েলি ব্র্যান্ড নয়, এমন কোম্পানিগুলো যাতে ইসরায়েলে ব্যবসা না করে এবং বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষার্থীরা যেন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা না করেন বা কোনোভাবে সম্পর্ক না রাখেন-এটাও চান বিডিএস আন্দোলনকারীরা।
যেসব প্রতিষ্ঠান ইসরায়েলি সামরিক অভিযানকে সমর্থন করে, সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার চান আন্দোলনকারীরা। তাঁদের আরও চাওয়া নিষেধাজ্ঞা, যার মাধ্যমে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ, সম্পদ জব্দ বা বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত করা যায়। অন্য কথায় মার্কিন সরকারকে নিষেধাজ্ঞায় অংশ নিতে হবে। কারণ, নিষেধাজ্ঞা যদি কার্যকর করতে হয়, তাহলে মার্কিনদের অংশগ্রহণ লাগবে। তবে ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, তাতে এর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
কে কীভাবে বিডিএসকে দেখছে
ফিলিস্তিনি ও তাঁদের সমর্থকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে বিডিএস। কিন্তু ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রে বিডিএসের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে সমন্বিত চেষ্টা দেখা যায়।
যাঁরা বিডিএস সমর্থন করেন, তাঁদের মধ্যে যদি ইহুদিও থাকেন, তাঁদের ইসরায়েলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে দেশটি। আর এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৩৮টি রাজ্য বিডিএসবিরোধী আইন করেছে। যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওই সব রাজ্যে কাজ করতে চায়, তাদের এমন অঙ্গীকার করতে হয় যে তারা বিডিএসের কর্মকাণ্ডে জড়িত হবে না। যেসব কোম্পানি বিডিএসের লক্ষ্যের প্রতি সমর্থন জানায়, সেসব কোম্পানি রাজ্য থেকে কোনো বিনিয়োগ তহবিলও পাবে না।
কিছু ইহুদি ইসরায়েলি পণ্য বর্জনের ডাকের সঙ্গে ১৯৩০-এর দশকে জার্মানিতে ইহুদি পণ্য বর্জনের মিল খুঁজে পান। নাৎসিরা ওই বর্জন কর্মসূচি চালিয়েছিল। আবার কিছু সমালোচক মনে করেন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি কোনোভাবেই বর্জনের অংশ হওয়া উচিত নয়। বিডিএস সমালোচকদের অনেকে আবার মনে করেন, দু-একটি ছাড়া বেশির ভাগ বিডিএস কৌশল ন্যায়সংগত।
ইসরায়েলে বাস করা ফিলিস্তিনিদের সমান অধিকার থাকা উচিত বলে বেশির ভাগ বিডিএস সমালোচক মনে করেন। দ্বিতীয় যে লক্ষ্য, অর্থাৎ ইসরায়েলের দখলদারত্বের অবসান; মূলত ইসরায়েলের ডানপন্থী সমর্থকেরা এর বিরোধিতা করেন। আবার অনেক ইসরায়েলি মনে করেন, পশ্চিম তীরসহ প্রাচীন ইসরায়েলের সব জায়গায় বসতি স্থাপনকারীদের বাস করার অধিকার রয়েছে।
তবে সবচেয়ে বিতর্কিত বিডিএস লক্ষ্য হলো, সব ফিলিস্তিনি শরণার্থীকে নিজ ভূমিতে ফিরে আসার অধিকার দেওয়া। কারণ, এমন ভয় রয়েছে যে এটা হলে ইহুদিরা ইসরায়েলে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে। ফলে ইসরায়েল আর ইহুদি রাষ্ট্র থাকবে না।
বিডিএসের কিছু সাফল্য
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে যাঁরা আন্দোলন করা বা ক্যাম্প বসিয়েছেন, তাঁরা কিছু সাফল্য পেয়েছেন। যেমন ব্রাউন ইউনিভার্সিটিতে আন্দোলনরতরা প্রশাসনকে একটি ভোটের আয়োজন করতে রাজি করাতে পেরেছেন। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত কোম্পানিগুলো থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করা হবে কি না, তা নিয়ে হবে এই ভোট। সমঝোতার পর বিক্ষোভকারীরা ক্যাম্প সরিয়ে নিতে রাজি হয়েছেন।
বোয়িংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক স্থগিত রাখতে রাজি হয়েছে পোর্টল্যান্ড স্টেট ইউনিভার্সিটি। বোয়িং বেসামরিক বিমান তৈরির পাশাপাশি সামরিক ঠিকাদারির কাজও করে থাকে। তবে সবচেয়ে বড় যে সাফল্য এই আন্দোলন থেকে এসেছে, তা হলো জনগণের কাছে ফিলিস্তিনি মানবাধিকারের বিষয়টি তুলে ধরা গেছে।