পশ্চিম তীরের জেনিন শহরে অভিযান চালায় ইসরায়েলি সেনারা
পশ্চিম তীরের জেনিন শহরে অভিযান চালায় ইসরায়েলি সেনারা

পশ্চিম তীরের অর্থনীতির টুঁটি চেপে ধরেছে ইসরায়েল

গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রামাল্লার অর্থনৈতিক বাস্তবতা নির্মম রূপ নিয়েছে। সুপারমার্কেটগুলো থেকে পণ্য চুরি ঠেকাতে নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। হাজার হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানকার সরকারি কর্মকর্তারাই বলছেন, বর্তমানে সেখানে যে অর্থনৈতিক সংকট শুরু হয়েছে, তা করোনাজনিত লকডাউনের চেয়ে গুরুতর। খবর দ্য ইকোনমিস্টের।

৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর পশ্চিম তীরের ইহুদিদের মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ইসরায়েলে কর্মরত ১ লাখ ৬০ হাজার ফিলিস্তিনির কাজের অনুমিত বাতিল করা হয়েছে। যদিও ইসরায়েলে অবৈধভাবে কাজ করে আরও লাখখানেক ফিলিস্তিনি। এ যুদ্ধ শুরুর আগে তাঁরা পশ্চিম তীরের অর্থনীতিতে ৩৭০ মিলিয়ন বা ৩৭ কোটি ডলার সঞ্চালিত করতেন।

ফিলিস্তিন নিজেদের সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করে না বলে প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটি (পিএ) আমদানি শুল্ক সংগ্রহের জন্য ইসরায়েলের ওপর নির্ভরশীল, যা তার মোট রাজস্বের ৬৪ শতাংশ। গাজায় যুদ্ধ শুরু হলে ইসরায়েলের অতি ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মরট্রিচ পিএর কাছে আর কোনো অর্থ স্থানান্তর করতে অস্বীকৃতি জানান। যদিও পরবর্তীকালে ইসরায়েলের সংসদ আপস করে; তখন তারা বলে, পিএ গাজাকে যে অর্থ দেয়, সেটা বাদ দিয়ে বাকিটা দেওয়া হবে। পিএর অর্থমন্ত্রী শুকরি বিসারা ক্রুদ্ধভাবে ইসরায়েলের এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এই অর্থ গ্রহণ করা হলে তা হবে গাজায় বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আমাদের সামাজিক চুক্তির লঙ্ঘন।’

বাস্তবতা হলো, হামাস ২০০৭ সাল থেকে গাজা নিয়ন্ত্রণ করলেও পিএ এখনো অনেক দায়দায়িত্ব বহন করে। যেমন গাজার বিদ্যুৎ বিল এখনো ইসরায়েলকে পরিশোধ করে তারা। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ফিলিস্তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ হাজার হাজার সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা তারাই পরিশোধ করে। ফিলিস্তিনের নিরাপত্তা বাহিনীকে ঘরে থাকার জন্যই বেতন দেওয়া হয়।

তাদের কারণে গত সাত অক্টোবরের পর থেকে পিএর রাজস্ব আয় ৮০ শতাংশ কমে গেছে। ফলে অর্থমন্ত্রী বিসারাকে এখন প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার বা ১৫০ কোটি ডলারের রাজস্বঘাটতি নিয়ে সরকার পরিচালনা করতে হচ্ছে। নভেম্বর মাসে তারা সরকারি কর্মচারীদের বেতন দিতে পারেনি, যদিও তারা কিছু কর্মীকে বেতনের অর্ধেক পরিমাণ ঋণ দিতে ব্যাংক অব প্যালেস্টাইনকে রাজি করাতে পেরেছে।

পিএর পরিচালন বাজেটের প্রায় ৩০ শতাংশ আসে বিদেশি সহায়তা থেকে, কিন্তু এ বছর তার পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র দশমিক ৭ শতাংশ। তা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনের অর্থনীতি এখনো সহায়তার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। দাতা গোষ্ঠীগুলো সরাসরি বাজেট সহায়তা দেওয়ার পরিবর্তে এখন উন্নয়নকাজে অর্থায়ন করছে, অংশত যার কারণ হচ্ছে পিএ কর্তৃপক্ষের ব্যাপক দুর্নীতি।

এসব কারণে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করার মতো ভালো অবস্থানে নেই পিএ।

আরেকটি বিষয় হলো, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের সদস্য না হওয়ায় তারা সেখান থেকেও সহায়তা পাচ্ছে না। তাদের নেই কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক, শেষমেশ যে তারা কারও ওপর ভরসা করবে, সেই বাস্তবতাও নেই। ফলে গাজার ব্যাংকগুলো পড়েছে বিপদে, প্রায় ১০০ কোটি ডলারের ঋণ অবলোপন করার পর তাদের এখন রীতিমতো ঘাম ছুটে যাচ্ছে। স্বাভাবিক সময় কর্মীদের ঋণ দেওয়া অর্থনীতির জন্য ভালো; কিন্তু এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে তাদের যদি শিগগিরই বেতন দেওয়া না হয়, তাহলে হাজার হাজার কর্মী ভোক্তাঋণ খেলাপি হয়ে পড়বেন।

বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো হয়ে এসেছে পুঁজি পাচারের ঘটনা, বিশেষ করে ফিলিস্তিনের নাগরিকদের মধ্যে যাঁরা জর্ডানসহ উপসাগরের অন্যান্য অঞ্চলে চলে যেতে চাচ্ছেন, তাঁরা পুঁজি পাচার করছেন বলে জানা গেছে। এ পরিস্থিতিতে প্যালেস্টাইন অথরিটি অর্থমন্ত্রী বিসারা দেশটির ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ করার ব্যাপারে সতর্ক হয়ে উঠেছেন। কারণ এতে আর্থিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়তে পারে।

এ পরিস্থিতিতে প্যালেস্টাইন অথরিটি অর্থমন্ত্রী বিসারা ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রীকে শুল্ক রাজস্ব ছাড় করার ব্যাপারে চাপ দিতে পারেন, যদিও তিনি তা করবেন কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ থেকে যায়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর ৩০ হাজার কর্মীর বেতন-ভাতা পরিশোধের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা মনে করছে, নিরাপত্তা কর্মীদের বেতন দেওয়া না গেলে নিরাপত্তাব্যবস্থাই হুমকির মুখে পড়বে।

বাধ্য হয়ে প্যালেস্টাইন অথরিটি আগামী ছয় মাসের জন্য কাতারের কাছ থেকে ৯০ কোটি ডলার চেয়েছে, কিন্তু কাতারসহ উপসাগরের দেশগুলো ইসরায়েলের যে অর্থ পরিশোধ করার কথা ছিল, তার দায় নিতে আগ্রহী নয়। আবার প্যালেস্টাইন অথরিটি এ সহায়তা নিলে অসলো চুক্তির আওতায় ইসরায়েলের যে অঙ্গীকার ছিল, সেখান থেকে তারা পিছিয়ে আসতে পারে। তবে এ ধরনের আর্থিক সহায়তা নিয়ে উদ্বেগ আছে। সেটা হলো, এ কারণে একদিকে যেমন দুর্নীতি অব্যাহত থাকতে পারে, তেমনি প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ব্যাহত হতে পারে। ফলে পশ্চিম তীর ও গাজার পরিচালনা ক্ষেত্রে প্যালেস্টাইন অথরিটি এখন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ভবিষ্যতেও তা থাকবে বলেই শঙ্কা।