জ্বালানির দর আবার এক বছর আগের পর্যায়ে ফিরে গেছে, যদিও দেশের বাজারে দাম এখনো কমেনি।
যদি বলা হয়, ২০২২ সালে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তার কারণে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে—এতে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। জ্বালানির বাড়তি দামের কারণে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। এতে তৈরি হয় এক অভূতপূর্ব সংকট।
২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে সারা বিশ্বেই কোভিডজনিত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা হয়। তখন থেকেই বাজারে চাহিদা বাড়তে শুরু করে। জ্বালানির দামও বাড়তে শুরু করে, যদিও লকডাউনের সময় একপর্যায়ে জ্বালানির দাম শূন্যেরও নিচে নেমে গিয়েছিল। একপর্যায়ে অপরিশোধিত তেল ব্রেন্ট ক্রুডের দাম প্রতি ব্যারেলে ৮০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। সে সময় বাংলাদেশ সরকারও ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে নতুন ৮০ টাকা নির্ধারণ করে। এর আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে গড়ে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ছিল ৪২ ডলার।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১২৭ ডলারে ওঠে। এর পর থেকে তেলের দাম ১১০ থেকে ১১৫ ডলারের মধ্যে ছিল। তবে কয়েক মাস ধরে জ্বালানির দর ধারাবাহিকভাবে কমছে। অয়েল প্রাইস ডট কমের তথ্যানুসারে, গতকাল এ প্রতিবেদন লেখার সময় ব্রেন্ট ক্রুডের দর ছিল প্রতি ব্যারেল ৮৩ দশমিক ৯২ ডলার। এখন আবার তা এক বছর আগের পর্যায়ে ফিরে গেছে, যদিও দেশের বাজারে দাম এখনো কমেনি।
* গতকাল ব্রেন্ট ক্রুডের দর ছিল ব্যারেলপ্রতি ৮৩ দশমিক ৯২ ডলার। * রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এই জ্বালানির দর ১২৭ ডলারে ওঠে।
২০২১ সালের নভেম্বর মাসে দেশের বাজারে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বৃদ্ধি করা হয়। এতে পরিবহন ও উৎপাদন ব্যয় অনেকটা বৃদ্ধি পায়। এর প্রভাবে বাজারে সবকিছুর দাম বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় শুরু হয় ডলার–সংকট। তখন সরকার আমদানি ব্যয় হ্রাস করতে বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করে। সব মিলিয়ে দেশের বাজারে পণ্যের দাম অনেকটা বেড়ে যায়। সরকারি হিসাবে বলা হয়, গত আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এরপর চলতি বছরের আগস্ট মাসে জ্বালানির দর সর্বোচ্চ ৫১ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়, যদিও এরপর বিশ্ববাজারে দাম কিছুটা কমলে দেশের বাজারে ডিজেলের দাম লিটারে ৫ টাকা কমানো হয়।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা সব সময়ই বলেছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমলে দেশের বাজারেও কমানো হবে। কিন্তু গত কয়েক মাসে জ্বালানির দাম ধারাবাহিকভাবে কমলেও দেশের বাজারে দাম কমানো হয়নি।
মূল বিষয়টি হচ্ছে চাহিদা ও সরবরাহ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, আগামী বছর বিশ্বের উন্নত দেশগুলো মন্দার কবলে পড়বে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় উন্নত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নীতি সুদহার বাড়ায়। এতে মূল্যস্ফীতি কমে এলেও চাহিদা পড়ে যাচ্ছে। ফলে ২০২৩ সালে আবারও অর্থনৈতিক সংকোচনের মুখে পড়বে তারা। এদিকে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মান সরকার বিপুল পরিমাণে জ্বালানি ভর্তুকি দিয়েছে, তাতেও মন্দার আশঙ্কা দূর করতে পারছে না তারা।
বিশ্বের বৃহত্তম জ্বালানি তেল আমদানিকারক দেশ হচ্ছে চীন। তার পরেই আছে ভারত। ফলে জ্বালানিবাজারে এ দুটি দেশের বিপুল প্রভাব। চীনের জ্বালানি চাহিদা কমে গেলে বিশ্ববাজারে জ্বালানির চাহিদা কমে যায়। সম্প্রতি বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্য হ্রাস পাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে চীনের লকডাউন। দেশটির বিভিন্ন স্থানে লকডাউন আরোপ করার কারণে দেশটির অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্তিমিত হয়েছে। তবে তারা শূন্য কোভিড নীতি শিথিল করেছে। এরপর দেশটিতে করোনা সংক্রমণের হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এ বাস্তবতায় আবারও বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ তেলের চাহিদা কমবে।
তেলের দাম বাড়ার কারণে সব দেশেই বিপাকে পড়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সৌদি আরব সফর করে দেশটিকে তেল উৎপাদন বৃদ্ধির অনুরোধ করেছেন। কিন্তু সৌদি আরব তাঁর কথায় কর্ণপাত করেনি। একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের কৌশলগত মজুত ভান্ডার থেকে তেল বিক্রি শুরু করে। এতেও দাম কমেনি। অনেক দেশ গোপনে কম দামে রাশিয়ার তেল কিনছে। পরিস্থিতির বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ না হলে তেল নিয়ে এই রাজনীতির শেষ হবে না।