লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে একের পর এক খনি আর অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে চীন। তবে ওই অঞ্চলে যাদের প্রভাব এত দিন ধরে সবচেয়ে বেশি ছিল, সেই যুক্তরাষ্ট্র খুব একটা আপত্তি জানায়নি। তবে অবস্থানগত কারণে লাতিন আমেরিকার যে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেই পানামায় এবার হাত বাড়িয়েছে চীন।
পুরো লাতিন আমেরিকায় চীনের ব্যবসা হু হু করে বাড়ছে। এসব দেশের সঙ্গে ২০০০ সালে চীনের ব্যবসার পরিমাণ ছিল মাত্র ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার। ২০২২ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৪৯ হাজার ৫০০ কোটি ডলারে। বেইজিং এখন দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার।
বিবিসি জানায়, চিলি, কোস্টারিকা ও পেরুর সঙ্গে চীনের মুক্তবাণিজ্য চুক্তি রয়েছে। মাত্র গত মাসেই ইকুয়েডর এমন একটি চুক্তি সই করেছে। অন্যদিকে পানামা ও উরুগুয়ে চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আরও জোরদার করার পরিকল্পনা করছে।
এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে নতুন কোনো বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মার্কোসুর চুক্তিভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে ২০ বছর ধরে আলোচনা করে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করার জন্য যে সমঝোতায় পোঁছেছে, তা অনুমোদন করতে পারছে না। মার্কোসুর চুক্তিভুক্ত দেশগুলো হলো ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে ও প্যারাগুয়ে।
পানামা দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র। পানামা খালের কারণে দেশটির রয়েছে বিশাল ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব। দুটো মহাসাগরকে যুক্ত করেছে এই খাল। এর ফলে বিশ্ববাণিজ্যে পানামা খাল বড় ভূমিকা পালন করে। এই অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক পানামার বিদেশনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
প্রায় ১৪০টি বহুজাতিক কোম্পানির সদর দপ্তর পানামায় অবস্থিত। দেশটি এসব কোম্পানিকে বিশেষ সুবিধা দেয়। এ ছাড়া আর্থিক ও লজিস্টিক কেন্দ্র হিসেবে পানামার বড় গুরুত্ব রয়েছে।
প্রকল্পের সংখ্যা বাড়ছে
পানামার প্রেসিডেন্ট লরেন্টিনো কোরটিজো ২০২২ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বর্ণনা করেন। তবে তিনি এটাও জানিয়ে দেন, যেসব দেশ পানামা খাল সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে, সেই তালিকার দ্বিতীয় স্থানেই আছে চীন।
এ ছাড়া পানামায় চীনের রাষ্ট্রদূত ওয়েই ছিয়াং অনেকবার এ কথা বলেছেন যে লাতিন আমেরিকা অঞ্চলে তাদের দেশের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। বিশেষ করে জ্বালানি, খনিজ সম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে।
আমেরিকাস কোয়ার্টারলিতে বিশ্লেষক এমিলি সোয়েগার্ট এবং আলোনসো ভেলাসকজ লিখেছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পানামা খাল অঞ্চলে বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে চীনা বিনিয়োগ বেড়েছে। এ ছাড়া চীনের সঙ্গে একটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করার আলোচনা, যা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে রয়েছে, তা–ও পুনরায় শুরু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন পানামার প্রেসিডেন্ট।
চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার এই প্রক্রিয়া অবশ্য শুরু হয়েছে পানামার সাবেক প্রেসিডেন্ট হুয়ান কার্লোস ভারেলার সময় থেকে। ২০১৭ সালের জুন মাসে মধ্য আমেরিকার দেশটি তাইওয়ানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে।
সে সময় পানামার সরকার বলেছিল, তারা এটি উপলব্ধি করেছে যে শুধু ‘একটিই চীন’ রয়েছে এবং তাইওয়ান সেই চীনের একটি অংশমাত্র। বেইজিং এবং তাইপের সরকারগুলো মনে করে যে তাদের দুটো দেশকেই একসঙ্গে স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব নয়।
আর চীন সব সময় মনে করে যে তাইওয়ান তাদের একটি বিচ্ছিন্ন প্রদেশ।
পানামা থেকে বাকি লাতিন আমেরিকা
সেই থেকে চীন পানামায় ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ শুরু করে বলে মনে করছেন ইউনিভার্সিটি অব পানামার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ইউক্লিডস টেপিয়া। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে চীনের বিবেচনায় ছিল বিশ্ববাণিজ্য–ব্যবস্থায় পানামার গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থান। তারা পানামার অর্থনীতির সব প্রধান খাতে বড় পরিমাণে অর্থ ঢালে।
ইউক্লিডস বলেন, ‘এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয় যে পানামায় প্রতিষ্ঠা করা ৪০টির মতো চীনা কোম্পানির অর্ধেকই দেশটিকে তাদের পুনঃ রপ্তানিকেন্দ্র বানিয়েছে, যেখান থেকে তারা লাতিন আমেরিকার বাকি দেশগুলোতে তাদের পণ্য পাঠায়।
ইউক্লিডস টেপিয়া বিশেষ করে কোলন–ফ্রি জোনের কথা উল্লেখ করেন। এটি সব ধরনের চীনা পণ্যের একটি লজিস্টিক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। এসব পণ্যের মধ্যে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে পোশাক, গৃহস্থালি সরঞ্জাম এবং সর্বোপরি ওষুধ রয়েছে। অতি সম্প্রতি চীন সেখানে গাড়ি তৈরিও শুরু করেছে। লক্ষ্য, ওই অঞ্চলের দেশগুলোতে গাড়ি বিপণন করা।
কাউন্সিল অব আমেরিকার ওয়াশিংটন দপ্তরের প্রধান এরিক ফ্রান্সওয়ার্থ বলেন, পানামা খাল একটি কৌশলগত সম্পদ। চীন তার নিজের স্বার্থে এর সুবিধা নিতে চায়। তাইওয়ানের ব্যাপারে পানামার সিদ্ধান্ত চীনের চেষ্টাকে আরও জোরদার করেছে।
ফ্রান্সওয়ার্থ আরও বলেন, পানামায় চীনের জোরালো উপস্থিতির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। আরও অনেক কিছু করা যেতে পারে, বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে অভিবাসীদের ঢল থামাতে যখন পানামা আরও বেশি সম্পদ চাইছে। এখন পর্যন্ত খুব বেশি অগ্রগতি অবশ্য হয়নি।
পানামায় ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক কার্লোস গেভারা মান বলেন, পানামায় চীনের উপস্থিতির কৌশলগত ঝুঁকির বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েই যুক্তরাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন করছে বলে মনে হচ্ছে।
চীন হতে সাবধান
কার্লোস গেভারা মান বলেন, চীনের বাড়বাড়ন্ত ঠেকানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তারা চীনের উপস্থিতি সম্পর্কে অভিযোগ করছে। কিন্তু এর বাইরে তারা কিছু করছে না। অনেক ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তা পানামায় এসে বলেছেন যে চীনের ব্যাপারে তাদের সাবধান থাকতে হবে। কারণ, তারা অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু বাস্তবায়ন করে খুব কম। তারা অনেক শর্ত দেয়, দীর্ঘ মেয়াদে যেগুলো পালন করা খুব কঠিন।
পানামার প্রেসিডেন্ট লরেন্টিনো কোরটিজো গত মাসে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস সংবাদপত্রকে বলেছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বক্তৃতা শুনতে বেশ ভালো শোনায়’, কিন্তু তাদেরকে বলতে হবে ‘অর্থনৈতিক সহায়তা সম্পর্কে আগের দেওয়া প্রতিশ্রুতির’ বিষয়ে তারা কী করতে চায়।
লরেন্টিনো কোরটিজো অবশ্য প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর চীনা সহায়তার কয়েকটি প্রকল্প স্থগিত করেছেন। এসব প্রকল্প তার পূর্বসুরি নিয়েছিলেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে খালের ওপর চতুর্থ একটি সেতু নির্মাণের প্রকল্প। তিনি বলেছেন, চুক্তির শর্তগুলো তিনি পর্যালোচনা করে দেখতে চান।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীন—উভয় দেশকেই খুশি রাখতে চায় পানামা। দুই দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখে তারা দুই তরফের কাছ থেকেই সুবিধা নিতে চায়। তবে যুক্তরাষ্ট্রে আর্মি ওয়র কলেজের ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের লাতিন আমেরিকা–বিষয়ক গবেষক ইভান এলিসের মতে, এটা আসলে ‘চৌকস একটি সিদ্ধান্তের বিষয়’।
ইভান এলিস বলেন, ওই অঞ্চলে চীনের অগ্রগতি এবং একই সঙ্গে সেখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তার সক্ষমতা এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর সঙ্গে তাদের নিজেদের সম্পর্ক—এই সবকিছু নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব উদ্বেগ এবং অস্বস্তি দুই–ই রয়েছে।
আর্থিক ও ব্যাংকিং সেবা
ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্র দপ্তরে কাজ করা ইভান এলিস আরও বলেন, ওই অস্বস্তির বিষয়টি দূরে সরিয়ে রেখে আমি এটা বলতে পারি যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চেয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সুর ভিন্ন হলেও কেউই বলছেন না যে তোমরা চীনের সঙ্গে ব্যবসা কোরো না।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, পানামার আর্থিক বা ব্যাংকিং–ব্যবস্থা নিয়েও আগ্রহী চীন। কাউন্সিল অব আমেরিকার ওয়াশিংটন দপ্তরের প্রধান এরিক ফ্রান্সওয়ার্থ বলেন, দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠা সম্পর্ক ‘কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশে চীনকে বিশেষ অবস্থান দিয়েছে’।
শুধু প্রতীকী অর্থে নয়, পানামায় চীনের সশরীর উপস্থিতির ফলে তারা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এবং খালের আন্তর্জাতিক ব্যবহারকারীদের সঙ্গে আরও ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে পারছে। একই সঙ্গে চীনা নাগরিকদের অভিবাসন থেকে শুরু করে কোলন–ফ্রি জোনের ব্যবহার—এ সবকিছুতেই চীনা স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে, বলেন এই বিশ্লেষক।
তবে ইউনিভার্সিটি অব পানামার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্কুলের অধ্যাপক ভেনিসিয়া চ্যাং মনটেরি মনে করেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে যে বিবাদ রয়েছে, পানামার উচিত তাকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগানো। ‘লাতিন আমেরিকা ও পানামার অবশ্যই এই সুযোগ কাজে লাগানে উচিত’, বলেন তিনি।
মনটেরি আরও বলেন, ‘আমরা জানি এবং সচেতন যে আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুই অর্থনীতির সঙ্গে বিতর্ক করছি।’
তবে দুই ধরনের পানিতে বৈঠা চালানো খুব সহজ কাজ নয়, বিশেষ করে এমন এক দেশের জন্য, যারা একই সঙ্গে বিনিয়োগও আনতে চায়, আবার সাবেক এক ঘনিষ্ঠ মিত্রকে রাগাতেও চায় না।