কোভিড–পরবর্তী সময়ে চীনের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার গতি হারিয়ে ফেলায় দেশটি এতকাল ধরে যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করল, সেই ভিত্তি নিয়েই সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এর ফলে বেইজিংয়ের সামনে আগামী বছর ও তার পরবর্তী সময়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। এখন তাদের হয় আরও বেশি করে ঋণ নিতে হবে, আর তা না হলে প্রবৃদ্ধির হার কমে যাবে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের শেষ দিকে চীন যখন কোভিডজনিত বিধিনিষেধ পুরোপুরি তুলে নিল, তখন ধারণা করা হয়েছিল, ক্রেতারা শপিং মলগুলোতে হামলে পড়বেন, বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ আবার বাড়বে, কারখানায় উৎপাদন বাড়বে এবং জমির নিলাম ও বাড়ির বাজার স্থিতিশীল হবে। কিন্তু বাস্তবে তেমনটা হচ্ছে না।
বরং দেখা যাচ্ছে, চীনের মানুষ এখন দুর্দিনের জন্য সঞ্চয় করছেন, বিদেশি ফার্মগুলো বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছে, চাহিদা কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কারখানাগুলো উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে, স্থানীয় সরকারের রাজস্ব আয় ও অর্থায়ন মুখ থুবড়ে পড়ছে আর সেই সঙ্গে আবাসন কোম্পানিগুলোর খেলাপি হওয়ার প্রবণতা আরও বেড়েছে।
চীনের অর্থনৈতিক পুনরুত্থান নিয়ে প্রত্যাশার বেলুনটি এভাবে চুপসে যাওয়ায় যাঁরা এত দিন চীনের প্রবৃদ্ধির মডেল নিয়ে সন্ধিহান ছিলেন, তাঁদের পালে কিছুটা হাওয়া লেগেছে। অনেকে এই পরিস্থিতির সঙ্গে জাপানের তুলনা করছেন। সেটা হলো, গত শতকের নব্বইয়ের দশকে অর্থনীতি স্থবির হওয়ার আগে জাপান কয়েক দশক ধরে উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। জাপানের জন্য নব্বই–পরবর্তী সময় হচ্ছে লস্ট ডিকেডস বা হারিয়ে যাওয়া কয়েকটি দশক।
কঠোর বাস্তবতা
চীন সম্পর্কে সন্দেহগ্রস্ত মানুষের যুক্তি, বেইজিং এখন পর্যন্ত অর্থনীতিকে নির্মাণ খাতভিত্তিক উন্নয়ন থেকে ভোগভিত্তিক প্রবৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে পারেনি, যেটা তাদের আরও এক দশক আগেই করা উচিত ছিল। চীনের ঋণের প্রবৃদ্ধির হার অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে স্থানীয় সরকার ও আবাসন কোম্পানিগুলো এখন ঋণের ভারে হিমশিম খাচ্ছে।
দেশটির নীতিপ্রণেতাদের অঙ্গীকার, তাঁরা অর্থনীতিকে আবাসন খাতনির্ভরতা থেকে ভোগনির্ভরতার দিকে নিয়ে যাবেন। দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার এখন ব্যাংকগুলোকে আবাসন খাতে ঋণ না দিয়ে উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন খাতে ঋণ দেওয়ার নির্দেশনা দিচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে কীভাবে এই ঋণ পরিশোধ করে অর্থনীতি পুনর্গঠন করা হবে, তার পথরেখা এখনো অধরাই থেকে যাচ্ছে।
চীন এখন যে পথই বেছে নিক না কেন, তাকে এখন দুটি বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করতে হবে। একদিকে দেশটির বয়স্ক জনগোষ্ঠী বেড়ে যাচ্ছে, আরেক দিকে মোট জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি দিনকে দিন আরও উত্তপ্ত হচ্ছে। এর ফলে চীনের পক্ষে এখন ব্যবসা করাও কঠিন হয়ে যাবে।
এ বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে চীনের ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। সেটা হলে তারা বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির গড় হার ছাড়িয়ে যাবে। এ কথা শুনে ভালোই লাগতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, চীনকে তার জিডিপির ৪০ শতাংশের বেশি পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়, যা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় দ্বিগুণ। কিন্তু সেখান থেকে দেশটিতে যে পরিমাণ উৎপাদন হওয়ার কথা, তা হচ্ছে না।
এর অর্থ হলো চীনের জনগণের বড় একটি অংশ প্রবৃদ্ধি অনুভব করতে পারেন না। সেই সঙ্গে চলতি বছরের জুন মাসে দেশটির তরুণদের বেকারত্বের হার ২১ শতাংশে উঠেছে। বাস্তবতা এত কঠিন যে চীন এরপর বেকারত্বের পরিসংখ্যান প্রকাশ করাই বন্ধ করে দিয়েছে।
চীনের জিডিপির ৩০ শতাংশ আসে আবাসন খাত থেকে। দেশটির মোট সম্পদের ৭০ শতাংশই এই খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও দেশটির গৃহমালিকেরা আগের চেয়ে বেশি চাপ বোধ করছেন। চীনের অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনা ছিল বৈদ্যুতিক গাড়ি, কিন্তু মার্কিন কোম্পানি টেসলা যেভাবে মূল্যযুদ্ধ শুরু করেছে, তাতে এই খাতের কর্মীরাও চাপের মুখে আছেন।
সম্ভাব্য সামাজিক অস্থিরতা
বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীনে যে ধরনের হতাশা তৈরি হয়েছে, তাতে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং সামাজিক অস্থিরতার মুখে পড়তে পারেন। এখন চীনের অবস্থা যদি জাপানের মতো হয়, তাহলে সমস্যা হলো জাপান উন্নয়নের যে পর্যায়ে ওঠার পর স্থবিরতার মুখে পড়েছিল, চীন এখনো সেই পর্যায়ে যেতে পারেনি।
চীনের এই পরিস্থিতির প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে আরও জোরালো হবে। কারণ, অধিকাংশ বৈশ্বিক শিল্প চীনের ওপর নির্ভরশীল। আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলো চীনের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। চীন যেমন এসব দেশ থেকে পণ্য আমদানি করে, তেমনি এসব দেশের শিল্পায়নে বিনিয়োগ করে থাকে।
রয়টার্সের সংবাদে বলা হয়েছে, চীন এমন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো সময় তার হাতে কম। চীনের নীতিপ্রণেতারা নীতিগত পরিবর্তনে আগ্রহী। অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের বিষয়ে তাঁরা অতীতে অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু চীনে সংস্কার করা খুবই কঠিন এক কাজ।
পরিকল্পনা ছিল, চীনের গ্রামাঞ্চলের কোটি কোটি প্রবাসী শ্রমিককে সামাজিক ভাতা দেওয়া হবে এবং তা জিডিপিতে প্রায় ১ দশমিক ৭ শতাংশ অবদান রাখবে। কিন্তু সে জন্য গ্রামাঞ্চলের মানুষের জন্য শহরাঞ্চলের মতো পরিষেবা কাঠামো তৈরি করতে হবে। চীন সরকার সেদিকে যায়নি। বরং এর ফলে সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে কি না এবং এই ব্যয় কীভাবে হবে—এ নিয়ে উদ্বেগের কারণে সেই পরিকল্পনাই ভেস্তে যেতে বসেছে।
চীনের সরকারি নীতিপ্রণেতারা ২০২৪ সালেও ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলেছেন। কিন্তু আগামী বছর তা অর্জন করা সহজ হবে না। এ বছর ২০২২ সালের নিম্ন প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও আগামী বছর ভিত্তি আরও শক্তিশালী হয়ে যাবে।
এই পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক ঋণমান নির্ধারণকারী সংস্থা মুডিস চীনের ঋণমান আভাস চলতি মাসে নেতিবাচক করেছে। এতে চীনের বাজারে শেয়ারের দাম পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। রয়টার্সের সংবাদে বলা হয়েছে, চীনের কেন্দ্রীয় সরকার কোন খাতে অর্থ ব্যয় করে, তার ওপরই সবকিছু নির্ভর করবে।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, আগের মডেলের আয়ু ফুরিয়ে গেছে।