তেল উৎপাদনকারী দেশের জোট ওপেক ও তার সহযোগী দেশগুলো হঠাৎ করেই তেল উৎপাদন হ্রাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই খবরে আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গেছে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম।
অয়েল প্রাইস ডটকমের তথ্যানুসারে, আজ সোমবার সকালে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ৫ দশমিক ১৬ ডলার বেড়ে হয়েছে ৮৪ দশমিক ১৭ ডলার। ডব্লিউটিআই ক্রুডের দামও বেড়েছে ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। তাতে বিশ্বজুড়ে শেয়ার সূচকেরও পতন হয়েছে।
ওপেক ও রাশিয়াসহ ওপেকের সহযোগী দেশগুলোর এক ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে তেল উৎপাদন হ্রাসের এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত কয়েক মাসে উন্নত দেশসহ বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমেছে। তাতে বিশ্ব অর্থনীতি যখন আশার আলো দেখতে শুরু করেছিল, তখন এই তেল উৎপাদন হ্রাসের খবরে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ আছে।
এতে মূল্যস্ফীতির হার আবার বেড়ে যেতে পারে। তখন ফেডারেল রিজার্ভসহ বিশ্বের অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদ বৃদ্ধির হার বাড়িয়ে দিতে পারে। তাতে মন্দার আশঙ্কা আরও ঘনীভূত হবে।
বিভিন্ন বাজার বিশ্লেষণকারী সংস্থাগুলো বলছে, এবার ওপেকসহ অন্য সদস্যরা যে তেল উৎপাদন হ্রাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই সিদ্ধান্তে তারা অনড় থাকতে পারে। এর অর্থ হলো মে মাস নাগাদ বৈশ্বিক জ্বালানি তেল সরবরাহ এক শতাংশের মতো কমতে পারে।
বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান পিকারিং এনার্জি পার্টনার্সের বিনিয়োগ বিভাগের প্রধান বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, এই সিদ্ধান্তে জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলে ১০ ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে।
বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসও তেলের দাম বাড়ার পূর্বাভাস করেছে। তারা বলছে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দর ব্যারেলপ্রতি ৯৫ ডলারে উঠতে পারে এবং ২০২৪ সালের শেষে তা ১০০ ডলারে উঠতে পারে।
এদিকে তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্বের বিভিন্ন শেয়ারবাজারে পড়েছে। আজ সকালে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ ফিউচার্স সূচক শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ পড়েছে। ন্যাসডাক ফিউচার্স সূচকের পতন হয়েছে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। ইউরোস্টকস ৫০ ফিউচার্স পড়েছে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। তবে এফটিএসই সূচকের উত্থান হয়েছে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব মোকাবিলায় ফেডারেল রিজার্ভ আবার নীতি সুদহার বৃদ্ধি করবে, এমন সম্ভাবনায় ডলারের বিনিময় হার কিছুটা বেড়েছে। জাপানি ইয়েনের বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। দরপতন হয়েছে ইউরোরও।
ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে সোনার দামও কিছুটা কমেছে। আজ বিশ্ববাজারে সোনার দাম আউন্সপ্রতি শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ কমে ১ হাজার ৯৫০ ডলারে নেমেছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিশ্ববাজারে ওপেক বলেছিল, অপরিশোধিত তেলের দাম আবারও ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। বাজারের চাহিদা ও জোগানের কারণে এমনটি হতে পারে বলে মনে করছে তারা।
কারণ হিসেবে তখন ওপেক বলেছিল, বিশ্বের শীর্ষ তেল আমদানিকারক দেশ চীন শূন্য কোভিড নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। ফলে সেখানে চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়ছে। এতে এ বছর জ্বালানি তেলের বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকবে বলে ধারণা করছে ওপেক। চাহিদা বেড়ে যাওয়ার বিপরীতে বিনিয়োগ-স্বল্পতাসহ নানা কারণে সরবরাহও সীমিত থাকবে।
এমন কথা বলার পর এবার ওপেক নিজেরাই উৎপাদন হ্রাসের কথা জানাল।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ৮ বছরের মধ্যে প্রথম ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এক পর্যায়ে তা কিছু সময়ের জন্য ১৩৯ ডলারে ওঠে।
কিন্তু ব্যাপক মূল্যস্ফীতির কারণে পশ্চিমা দেশগুলোতে পণ্যের চাহিদা কমে যায়। তার ধাক্কায় তেলের দাম ধারাবাহিকভাবে কমতে শুরু করে।
গত বছর প্রায় পুরো সময় চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে লকডাউনসহ কোভিডজনিত নানা বিধিনিষেধ ছিল। এতে দেশটিতে চাহিদা ছিল কম। এসব কারণে গত বছরের শেষ দিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানির তেলের দাম যুদ্ধের আগের অবস্থায় ফিরে যায়। কিন্তু এখন আবার তা বাড়তে শুরু করে।
এদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বিশ্বের বড় ছয়টি জ্বালানি তেল কোম্পানি ২০২২ সালে সব মিলিয়ে ২১ হাজার ৫৪০ কোটি মার্কিন ডলার মুনাফা করেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছে গত বছর।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব সাধারণত বহুমাত্রিক হয়। প্রথমত, এতে পণ্য পরিবহন খরচ বাড়ে, তার সঙ্গে বাড়ে উৎপাদন খরচ। এতে সব পণ্যের দাম বেড়ে যায়।
সেই সাথে যেসব দেশ আমদানিনির্ভর, তাদের দুর্দশার মধ্যে পড়ে। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে তাদের বিদেশি মুদ্রার ভান্ডারে টান পড়ে।